আশুলিয়ায় গুলির বৃষ্টি, লাশ পোড়ানো

 

।। মাসুক আলতাফ চৌধুরী।।

দেশজুড়ে তখন বিজয় মিছিল। তারপরও থেমে ছিল না কতিপয় পুলিশের উন্মত্ততা। আশুলিয়া থানা রোডের গুলিবিদ্ধ লাশ জড়ো করে পুড়িয়ে দিয়েছিল পুলিশ। ইতিমধ্যে মাস্টারমাইন্ড অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আব্দুল্লাহিল কাফিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রিকশাভ্যানে লাশ তোলার অপর দুই পুলিশ কর্মকর্তাকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। ঘটনাতো ৫ আগস্ট বিকালের। তখন সরকার পালিয়েছে, এরপরও গত তিন সপ্তাহ ধরে দেশবাসী জানতেই পারলো না সেদিন এমন গা শিউরে ওঠা নিষ্ঠুর ঘটনাও ঘটানো হয়েছে। ছাত্র- জনতার রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি।

সেদিন বৃষ্টিরমতো গুলি ছুঁড়েছে পুলিশ। নিজেদের রামরাজত্ব শেষ জেনেও তখনও কেন ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ। আশুলিয়া কি বাংলাদেশের ভূখন্ডে নয়। ক্ষমতার মোহ তাদের অন্ধ করে রেখেছিল। হত্যা-গুম- ক্রসফায়ারে দায়মুক্তি পেতে পেতে তারা হয়ে উঠেছিল দানব।

যার ধারাবাহিকতায় বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট সকাল ৯ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত নিপীড়ক পুলিশ, ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে আশুলিয়ায় নিহত হন অন্তত ৩১ জন। পরদিন গুরুতর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ১৫ জন মারা যান। ওই সময়ের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৬ জনে। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল দেড় হাজারের বেশি মানুষ। যাদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। যাদের আগুনে পোড়ানো হয়েছে তারা তাদের বেশির ভাগই ছাত্র। সাভার ও আশুলিয়ায় ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যায় ৭৫ জন। তবে কেমন করে অলক্ষ্য হয়ে পড়া এমন নির্মম সত্য বেরিয়ে আসলো জনসম্মুখে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল এক মিনিট ১৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। সেখানে দেখা যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকাদের দু’ জন পুলিশ সদস্যের একজন হাত ও অন্যজন পা ধরে রিকশাভ্যানে নিক্ষেপ করছে। নিথর দেহ, দেহে প্রাণ ছিল কিনা জানা যায়নি। তবে গনমাধ্যম মৃতই বলেছে। এর আগেই রিকশাভ্যানে লাশের স্তূপ করে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন তারা। সর্বশেষ লাশটি তুলে একটি পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে সেগুলো ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। শেষে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি স্পষ্টত দেখা মিলে।

ওই ভিডিওর সূত্র ধরে ৩১ আগষ্ট শনিবার জাতীয় দৈনিক মানবজমিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ঘটনার বিস্তারিত। যদি কেউ সাহস নিয়ে ভিডিও না করতেন, এবং পরে তা ফেসবুকে না ছাড়তেন তবে কি এমন নিষ্ঠুরতাও সবার অলক্ষ্যেই থাকতো। ভিডিওটি আশুলিয়া থানার সামনের ভবনের দ্বিতীয়তলা থেকে ধারণ করা। এরতো স্থানীয় স্বাক্ষী, ক্ষতিগ্রস্ত সবই ছিল। তারপরও ঘটনাস্থল থেকেই কেন এর বিস্ফোরণ ঘটলো না। দেশবাসী জানতে হলো ফেসবুকের সূত্র থেকে। ওখানকার সাংবাদিকতা কেন থেমে ছিল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন এমন নিষ্ঠুরতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হলো। এসবের উত্তর খোঁজা জরুরি। এতগুলো প্রাণ বৃথা যেতে পারে না। এরাইতো বিজয়গাঁথা তৈরি করেছে। এতো তাড়াতাড়ি এদের ভুলে গেলে বিজয় সুসংহত হবে কেমন করে। পরিবর্তন চাইলে আগে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। অপরাধ জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে।

ওই প্রতিবেদন বলছে, রিকশাভ্যানে পুলিশের লাশের স্তুপ করে রাখা মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে আশুলিয়া বাইপাইল এলাকার থানা রোডের গলিতে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট সেখানকার ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার কোয়ার্টারের দেয়াল ঘেঁষে গুলিবিদ্ধ ৭ ছাত্রের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। পুলিশ লাশগুলো একত্রিত করে ভ্যানের ওপর স্তুপ করে রাখে। পরে লাশগুলো থানায় পার্ক করা একটি পিকআপে তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, বীভৎস।

ভিডিওতে একটি পোস্টার দেখা যায়। যা স্থানীয় ধামসোনা ইউনিয়ন সভাপতি প্রার্থী ও ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেনের। সেই পোস্টারটি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ভিডিওটির ঘটনাস্থল আশুলিয়া থানার পাশে। মহাসড়ক থেকে থানার দিকে অগ্রসর হয়ে এসবি অফিসের দিকে চৌরাস্তায়ও রিকশাভ্যানে লাশ তোলা হয়।

কেন এমন করলো পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের গণমাধ্যমে ভাষ্য, ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপর বাইপাইল এলাকায় বিজয় মিছিল বের হয়। বিকেলে উত্তেজিত ছাত্র- জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করে। এ সময় আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানা ভবনে ঢুকে গেট বন্ধ করে দেয়। বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলে ও ইট- পাটকেল ছুড়তে থাকে। কেউ কেউ গেট ভাঙতে এগিয়ে যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় থানার ওসি পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। এতে আন্দোলনকারীরা আরও চড়াও হয়। ওই সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে ৩০-৩৫ জন পুলিশ সদস্য থানার গেটে অবস্থান নেন। উত্তেজিত জনতা ‘ ভুয়া ভুয়া’ শ্লোগান দিতে থাকে। এক পর্যায়ে ওসি পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র হাতে নিয়ে রেডি হতে বলেন। জবাবে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। তখন ওসি বলেন, আমরা হেরেছি, আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন, সবাই বাড়ি ফিরে যান। এর এক পর্যায়ে এসআই মালেক, ডিবির পরিদর্শক তদন্ত আরাফাত, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল ছাত্র- জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিতে থানার গলিতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। মুহুমুহু গুলিতে আন্দোলনকারীরা দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।

থানার সামনের বিল্ডিং থেকে পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রনি আহমেদের ভাষ্য, এতে থানা গেটেই ১০-১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। পরে জীবিত কয়েকজনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরও ৬-৭ জন ওখানে পড়েছিল। ততক্ষণে আশপাশের সব অলিগলি জনতা ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ একযোগে গুলি করতে করতে সশস্ত্র হয়ে একযোগে বেরিয়ে আসেন।

থানা গেটের সামনের এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, বিকাল সাড়ে ৪ টা হবে। গুলি খেয়ে থানার সামনে পড়ে থাকা ৭ জনকে একটি রিকশাভ্যানে তুলে পুলিশ। পরে তাদের থানার সামনে এনে লাশগুলো পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের একটি পিকআপভ্যানে তুলে আগুন দেয়। এরপরই পুলিশ থানা থেকে বেরিয়ে গলি দিয়ে হাঁটতে শুরু করেও আবার একের পর এক গুলি ছুড়তে থাকে।

ওইদিন প্রাণ হারানো দশম শ্রেণির ছাত্র আসশাবুর। তার বড়ভাইয়ের ভাষ্য, গুলিবিদ্ধ আমার ছোট ভাই থানার পাশের রাস্তায় পড়ে ছিল। পিকআপে ঢুকিয়ে তাকেও আগুন দেওয়া হয়। গায়ের নীল গেঞ্জি দেখে পোড়া লাশ শনাক্ত করি। আগুন দেওয়ার আগে ভাইটি জীবিত না মৃত ছিল তা জানার সুযোগও আমাদের হয়নি।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী এক অটোরিকশা চালকের ভাষ্য, পুলিশ থানা থেকে মেইন রোডে এসে ডান-বাম দু’ পাশেই গুলি চালায়। এক মিনিটের জন্যও পুলিশ গুলি বন্ধ করেনি। যতক্ষণ হেঁটেছে ততক্ষণই গুলি ছুড়েছে। রাস্তার দু’ পাশে পথচারী, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের শত শত মানুষ সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়। এমন দিন কখনও দেখেনি বাইপালবাসী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে, একটি ড্রোন উড়িয়ে আন্দোলনরত ছাত্র- জনতার অবস্থান শনাক্ত করা হয়। কার ড্রোন ব্যবহার করলো পুলিশ। অথবা কে ড্রোন ব্যবহার করে পুলিশকে সহায়তা করলো।

ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রিয়াজ উদ্দিনের দাবি তারা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাফির নির্দেশ পালন করছেন। কেন তিনি সব জেনে শুনেও এতো হিংস্র হলেন। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। পুলিশের তদন্ত কমিটি বলেছে আরও দুই পুলিশ কর্মকর্তা চিহ্নিত হয়েছেন। পুলিশের তদন্ত পুলিশ করছে। ঘটনার ভয়াবহতাতো বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি রাখে। অথবা যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করে এমন ঘটনাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রয়োজন। তারপর মামলা। না হলে দায়সারা গোছের লামসাম তদন্ত হবে। মামলা হবে গুটি কয়েকজনকে আসামি করে। বাকি অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক।