এলোমেলো ময়নামতি জাদুঘর -বিভ্রান্ত দর্শনার্থী

আবদুল্লাহ আল মারুফ।।
কুমিল্লা ময়নামতি জাদুঘরের এলোমেলোতে প্রদর্শনীতে বিভ্রান্ত দর্শনার্থীরা। সৃষ্টির শুরু থেকে ৬ দশকেও আধুনিক জাদুঘর বিদ্যার ছোঁয়া পায়নি ময়নামতি। ইতিহাসবিদদের দাবি এটি গোছানোর। যাতে এক নজরে প্রত্নবস্তুর ইতিহাস জানা যায়।
সূত্রমতে, আধুনিক জাদুঘর বিদ্যার প্রদর্শনীর সাথে এর সমঞ্জস্যতা এখনও গড়ে উঠেনি। যেকারণে পিছিয়ে পড়েছে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরটি। তিন গুণের বেশি নিদর্শন রয়েছে পর্দার অন্তরালে। আর এসব কারণে ভ্রমণপিয়াসীদের তৃষ্ণা মেটাতে পারছেনা বলে অভিযোগ উঠেছে।
ময়নামতি জাদুঘর সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার শালমানপুর নামক গ্রামে ময়নামতি জাদুঘরের অবস্থান। ১৯৬৫ সালে ময়নামতি জাদুঘর স্থাপন করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ে অবস্থিত শালবন বিহার, কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবান মুড়া মন্দির ও বিহার, ইটাখোলা মুড়া মন্দির ও বিহার, আনন্দ বিহার, রাণীর বাঙলো, ভোজ রাজার প্রাসাদ, প্রভৃতি স্থানের প্রতœবস্তুর সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ময়নামতি জাদুঘর স্থাপন করা হয়। কালের বিবর্তনে জাদুঘর ভবনকে বর্ধিতকরণ, বিশ্রামাগার নির্মাণ ও ফুলের বাগান গড়ে তোলা হয়।
ময়নামতি জাদুঘর ভবনে ৯০টি প্রদর্শনী শোকেস রয়েছে। এই জাদুঘরে প্রাচীনকালের ভূমি-নকশা, ধাতব লিপিফলক, প্রাচীন মুদ্রা, মাটির মুদ্রক- মুদ্রিকা, পোড়ামাটির চিত্রফলক, ব্রোঞ্জের মূর্তি, পাথরের মূর্তি লোহার পেরেক, পাথরের মূর্তি, গুটিকা, গহনা, গৃহস্থালী দ্রব্যাদি ইত্যাদি প্রায় ৭০০ প্রত্নবস্তু প্রদর্শিত রয়েছে। আদি ঐতিহাসিক পর্যায়ের প্রাচীন সমতট (কুমিল্লা- নোয়াখালী) ভূ-খণ্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করা হয়।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এজাদুঘরে প্রদর্শিত রয়েছে ১২০০-১৩০০ বছর পূর্বের মেটেপাথরের দ-ায়মান বুদ্ধ, ব্রোঞ্জের বজ্রসত্ত্ব, ব্রোঞ্জের অবলোকিতেশ্বর, ব্রোঞ্জের ঘণ্টা, পাথরের মারীচী, স্থানক বিষ্ণু, তারা, গণেশ, সূর্য, প্রভৃতি। রয়েছে ভূমি-নকশা, ধাতব লিপিফলক, প্রাচীন মুদ্রা, মাটির মুদ্রক-মুদ্রিকা, পোড়ামাটির চিত্রফলক, ব্রোঞ্জের মূর্তি, পাথরের মূর্তি লোহার পেরেক, পাথরের মূর্তি, গুটিকা, গহনা, গৃহস্থালী দ্রব্যাদি। ময়নামতি জাদুঘরে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত এসব প্রত্নবস্তু প্রাচীন বঙ্গ, হরিকেল ও সমতট জনপদের অতীত স্মৃতি বহন করছে। কিন্তু সেগুলো শুরু দিকে যেমন পরিকল্পনা ছাড়াই রাখা হয়েছিল আজও তেমন। কর্মকর্তা বদল হলেও এই জাদুঘরের ভেতরের পরিস্থিতি কখনও বদল হয়না। কোথাও বুদ্ধের সাথে আছে বিষ্ণু। আবার কোথাও আছে গণেশের মূর্তির পরে বুদ্ধের মূর্তি। যা দেখে কোনভাবেই বুঝার উপায় নেই কোনটা কোন ধর্মের গুরুত্ব বহন করে বা কোন মূর্তি কোন ধর্মকে ধারণ করে বা তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলে কাদের আধিক্য বেশি ছিল। এই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব কারা করতো। তেমন কিছুই বুঝা যায়না। যে কারণে দর্শনার্থীরা পড়েন বিভ্রান্তিতে। শুধু মূর্তিই দেখে যান কিন্তু এ থেকে কোন শিক্ষা অর্জন সম্ভব হয়না। আবার কোথাও কোথাও ষষ্ঠ শতকের প্রতœবস্তুর পরেই আছে দ্বাদশ শতকের প্রত্নবস্তু। কিছু কিছু মূর্তির সাথে শুধু নাম ও প্রাপ্তির স্থান যুক্ত রয়েছে কিন্তু এর ইতিহাস ও গুরুত্ব উল্লেখ নেই। যা শুধু দেখাই যায় কিন্তু কোন কাজে আসে না।


কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ সোহেল বলেন, এখন আধুনিক যুগ। আধুনিক যুগে হাতে তৈরি মানচিত্রের চেয়ে থ্রিডি আকারে প্রদর্শিত কোন বিষয় বেশি আকৃষ্ট করবে। জাদুঘরের ঢুকতেই একটি ম্যাপ রয়েছে। সেটি থ্রিডিতে প্রদর্শিত হতে পারতো। আগের যুগের জিনিসপত্র এখনও চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এগুলোতে পরিবর্তন দরকার।
কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকে ময়নামতি জাদুঘর দেখতে আসা স্কুল শিক্ষক আবদুল আলীম বলেন, আমরা দেখার জন্য এসেছি। সবই দেখলাম কিন্তু তেমন কিছু বুঝার নেই। কারণ, এখানে শুধু মূর্তি গুলো সাজানো আছে। কয়েকটা মূর্তিতে সামান্য ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু গুলোতে কোন ব্যাখ্যা নেই। কোনটা কোন যুগের বুঝা যায়। কিন্তু আরও সুন্দর হতো যদি একই সময়কালের সকল নিদর্শন এক সঙ্গে রাখতো। কোন পরিকল্পনা ছাড়াই রাখা হয়েছে এসব নিদর্শন। শিক্ষার্থীদের কোন কাজে আসবে না।
কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দীন এই প্রতিবেদককে বলেন, এটা সত্যি যে কুমিল্লার ময়নামতি জাদুঘর আধুনিক জাদুঘর বিদ্যায় পরিপূর্ণতা পায়নি। তবে এটি দেশের একটি অন্যতম সমৃদ্ধ জাদুঘর। এই জাদুঘর দেখেই যে কেউ বুঝে যাবে এই অঞ্চলের অতীত। কিন্তু জাদুঘরকে ঐরকম রূপ দিতে হবে। এই মূর্তি গুলো কাদের? তারা কেন এখানে এসেছেন? এই জাদুঘরে একজন দর্শনার্থী কেন আসবে? এসে কি নিয়ে যাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর থাকতে হবে। একের পর এক প্রতœ বস্তু দিয়ে একই মালায় ইতিহাসকে গাঁথতে হবে। যেন কেউ প্রতœবস্তুর সামনে দাঁড়ালেই তার সামনে ইতিহাস ভেসে উঠে।
জানা গেছে, এই জাদুঘরে অপ্রদর্শিত অবস্থায় রয়েছে দুই হাজারের বেশি প্রত্নবস্তু। যা কখনোই দর্শকদের জন্য প্রদর্শন করা হয়নি। এরমধ্যে রয়েছে নোয়াখালী অঞ্চল থেকে পাওয়া মোঘল শেষ আমলের তরবারি জোড়া ও বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন মানদণ্ডের রুপার ৬৭৭ মুদ্রা। তবে জাদুঘর কর্তপক্ষের দাবি এসব অপ্রদর্শিত প্রতœবস্তুর মধ্যে একইরকম প্রতœবস্তু রয়েছে যার একটি প্রদর্শিত বাকিগুলো সংরক্ষণে রয়েছে। জায়গা সংকুলান, লোকবল সংকট ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে এসব প্রতœবস্তু জাদুঘর সৃষ্টির পর থেকে কখনই প্রদর্শন করা হয়নি।
তবে জাদুঘরের কাস্টডিয়ান শাহীন আলম বলেছেন, নোয়াখালী থেকে পাওয়া মোঘল শেষ আমলের তরবারি জোড়া প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগিরই তা প্রদর্শন করা হবে।
কেমন জাদুঘর চান এমন প্রশ্নে কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর এই প্রতিবেদককে বলেন, জাদুঘর হবে ইতিহাসের পঞ্জিকার মতো। যাতে ইতিহাসকে দেখা যাবে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য কুমিল্লার ময়নামতি জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলো আমরা এলোমেলো দেখেই বড় হয়েছি। যারা এসব সম্পর্কে ধারণা রাখে তারা দেখেই বুঝে যায় কোনটার ইতিহাস কি। কিন্তু এখানে এসে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কুমিল্লার মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এভাবে একটি জাদুঘর রয়েছে তা অবিশ্বাস্য। কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দীন বলেন, সম্প্রতি আমাদের বলা হয়েছে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে। আমরা শুরু করেছি। প্রতœ বস্তুর নামের সঙ্গে ছোট আকারে হলেও একটা ইতিহাস লেখা, সেগুলো সাজানোসহ বিভিন্ন কাজে আমরা সহযোগিতা করছি। আশা করি কুমিল্লার এই সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা দেশের অন্যতম একটি জাদুঘর হয়ে উঠবে।
কুমিল্লার ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টডিয়ান শাহীন আলম বলেন, আড়াই হাজার বছর আগের নব্য প্রস্তর যুগের প্রত্নবস্তুও আছে এই জাদুঘরে। কিন্তু এই জাদুঘর সাজানো হয়নি। সময়, ধর্ম, স্থান, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে জাদুঘর সাজানো হয়। আমি এসেই নোয়াখালী থেকে আনা মোঘল শেষ আমলের তরবারি প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত করছি। এছাড়া প্রত্নবস্তু গুলোকে সাজানোর কাজও করছি। সময় এবং উদ্যোগ নিলে সবই সম্ভব। আমরা চেষ্টা করছি আশা করি খুব দ্রুতই কুমিল্লার এই জাদুঘরকে সুসজ্জিত করে দর্শনার্থীদের কাছে আরও সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হবে।