গনগনে মধ্য দুপুর

 

।। মাহফুজ নান্টু।।

১.
শীতের দুপুর। ভাত খেয়ে রওনা হলাম। আজ হাটবার। আব্বুর সাথে হাটে যাচ্ছি। মনে কত আনন্দ। আজ একটি ক্রিকেট বল কিনবো।এরোপ্লেন কোম্পানির বল।
দোকানের সামনে ঝুলানো থাকে। হলুদ আর সাদা রঙের বল। ৯০ দশকের শেষ দিকে যারা আমার মত কিশোর ছিলো তাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ছিলো এই বল। তখন বলের চেয়ে দামী বস্তু আর কিছুই মনে হতো না।
পাড়ার বন্ধুরা মিলে ধানক্ষেতে পিচ বানিয়েছি। গাছের ডাল কেটে স্টাম্প। খুশিতে আটখানা। কাল থেকে খেলা হবে।
অগ্রহায়ণ মাস। ধান কাটা শেষ। ক্ষেতের আল ধরে হাটছি। হাটে গিয়ে বাজার সদাই কিনে বাড়ি ফিরবো। আব্বু সামনে হাটছে – পেছনে আমি। আমার হাতে ব্যাগ আর চোখে স্বপ্ন। হাটে গিয়ে কখন বলটা কিনবো।
হাটে পৌঁছে আব্বু তরকারি কিনলেন, মাছ কিনলেন। কিছু সিঁদল শুটকি কিনলেন। সিঁদল কেনার আগে নাকের কাছে নিয়ে শুকে দেখলেন। কি ঘ্রাণ! বাজার সদাই প্রায় শেষ। আমি বার বার আব্বুকে ইঙ্গিত করছিলাম বল কেনার জন্য। আব্বু চোখে মুখের ইশারায় আমাকে আশ্বস্ত করেন। কিনে দিবেন। আমি তাকিয়ে থাকি দোকানে। দোকানের পলিথিনে মোড়ানো ক্রিকেট বলের দিকে।
আব্বুর নিজের ও আম্মার জন্য পান সুপারি কিনেন। একশ’ টাকার বাজার সদাই কেনা হয়। ওই একশ’ টাকা দিয়ে বাজার করতে আব্বু আঙ্গুল গুণে কত যে হিসেব করলেন। এর মধ্যেই আমি আব্বুকে বল কেনার জন্য বলি। বলটার দাম ১৫ টাকা। একশ’ টাকার মধ্যে ১৫ টাকার বল কেনা হলে ঘরে শাক সবজি আনা সম্ভব হবে না। ছয়জন সদস্যের সংসার। তরকারি, মাছ পান সুপারি কেনা শেষ। আব্বুর হাতে বাকি আছে ৬ টাকা। আমি বুঝে গেছি আমার জন্য আর বল কেনা হবে না। আব্বু কিছুই বলেন না। হাট থেকে বাড়ির পথে হাটেন। আমিও আব্বুকে অনুসরণ করে পেছন পেছন হাটি। আমার আর বল কেনা হয় না। হাতের ব্যাগটাকে তখন পৃথিবীর সব থেকে ভারি মনে হচ্ছিলো। যখন বল ঝুলানো দোকানটার সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিলাম খুব অসহায় লাগছিলো।
এদিকে ছেলেকে বল কিনে দিতে না পারার অক্ষমতাও আমি আব্বুর চোখে মুখে দেখেছি। বাড়ি আসা পর্যন্ত চোখ বেয়ে পানি পড়েছে আমার। তারপর কত বছর কেটে গেলো। কত কিছুর পরিবর্তন হলো। আব্বুও চাকরি থেকে অবসরে আসলেন।
২.
দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছি। সূর্য উকি দিচ্ছে। পুকুরে দুই তিনটা হাঁস জলকেলি করছে। গোছল করে অফিসে যেতে হবে। আমি এখন সংসারী। মাঝে কেটে গেলো কতগুলো বছর। এখন বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে চাচারা আসেন। আমার সাথে শলাপরামর্শ করেন। কোরবানির ঈদে কোন হাট থেকে গরু কিনবেন, কি প্রস্তুতি আমি তাদের বলি। সংসারে এখন তেমন অভাব নেই। আবার খুব বেশী প্রাচুর্য নেই। চাচারা আমার কথায় সায় দেন। আমি খালি গায়ে গামছা জড়িয়ে কথা বলি। মুরুব্বি হয়ে গেছি। সকালের সূর্য কখন যে মাথার উপরে চলে এসেছে টের পাইনি। এখন জীবনের মধ্য দুপুর।
গত কয়েক বছর আগেও প্রতিটা ভোর রাতে আব্বুও ঘুম থেকে উঠে এই পুকুর ঘাটে এসে দাঁত মাজতেন। জোরে জোরে কাশি দিয়ে ওজু বানিয়ে মসজিদে যেতেন। সমধুর কন্ঠে আযান দিতেন। মসজিদে কোরান তেলোয়াত করতেন।
এগুলো ভাবতে ভাবতে আমার চোখে চলে যায় পুকুর থেকে কিছুটা দূরে। কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠে। লতাপাতা ও ফুলের গাছে মোড়ানো কবরস্থানটার দিকে। আব্বু শুয়ে আছেন সেখানে। আমার এখন বল দরকার নেই। জীবনে পরামর্শ দেয়ার জন্য আব্বুকে দরকার। আঙ্গুল গুণে কিভাবে সংসার চালাতে হয় সেটা জানা দরকার। কাঁধে হাত রাখার জন্য মানুষটাকে দরকার। এই আশ্রয়টা নেই- এই ছাতাটা নেই বলে গনগনে মধ্যদুপুরে আমাকে হাটতে হয়। এই হাঁটার মাঝে চোখেমুখ হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসে। ক্লান্তি লাগে। খুব একা লাগে….।

লেখক: কুমিল্লা প্রতিনিধি,নিউজ বাংলা ২৪।