মো: ছাইদুল ইসলাম।।
হযরত মুহাম্মদ (সা:) ছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট মহামানব ও সারা বিশ্বের নিদর্শন। তিনিই ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শের ধারক বাহক। তিনি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে ছিলেন সারা বিশ্বের রোল মডেল ও অনুকরণীয়। রাসুল (সা:) এর সিরাত ও সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমেই পৃথিবীর সকল মানুষের জীবন মান উন্নত হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসুল (সা:) এর আদর্শের বাস্তব প্রয়োগ তথা এর আলোকে জীবন পরিচালনা করাই মুখ্য ও প্রধান বিষয়। মুসলিম উম্মাহর প্রথম স্তর সাহাবায়ে কেরাম (রা:), তাদের জীবনে প্রতিটি দিক ও বিভাগে রাসুল (সা:) এর পূর্ণঅনুসরণ থাকায় তাদের যুগকে সর্বোত্তম যুগ বলে রাসুল (সা:) অভিহিত করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ ও অনুকরণে কোন কৃত্রিমতা ছিলনা। তারা সকল প্রকার উপহাস ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাসুল (সা:) এর আদর্শকে তাদের জীবনে পূর্ণ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। খোলাফায়ে রাশেদার যুগে রাসুল (সা:) এর নীতি ও আদর্শের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার কারণে এ যুগকে সোনালী যুগ বলা হয়। “তোমাদের জন্য অবশ্যই আল্লাহর রাসুলের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে; এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত ও পরকালে (মুক্তির) আশা করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে’’ সূরা আহযাব, আয়াত নং-২১। রাসুল (সা:) এর গৃহিত কর্মনীতি ও পদক্ষেপ ছিল সাহাবায়ে কেরাম (রা:) এর জন্য আদর্শ। সে সময় রাসুল (সা:) নিজে নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং তার সঙ্গী সাথীদের সাথে সীমাহীন কষ্ট ভোগ করেছেন। নিষ্ঠাবান মুমিনরা আন্তরিকভাবে তার সকল নির্দেশ মেনে চলেছেন। যাদের মাঝে সন্দেহ সংশয় ছিল তারা নানাভাবে পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করেছিল। মুসলমানগণ কেয়ামত পর্যন্ত মুহাম্মদ (সা:) এর আদর্শ শর্তহীন ভাবে মেনে চলবে। মানুষের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্য থেকে রাসুল মনোনীত করেন এবং যিনি রাসুল হিসেবে মনোনীত হন তিনি তার অনুসারীদের জন্য আদর্শ। আদম (আ:) প্রথম মানুষ ও নবী এবং দুনিয়ায় আসার সময় ভীত সন্ত্রস্ত আদম (আ:)কে আল্লাহ পাক অভয়বানী দিয়েছেন। “আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে তা অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয়ের কারণ নেই’’ সূরা বাকারা ৩৮। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর গোলামী করার জন্য এবং গোলামী করার পন্থা বলে দিয়েছেন তার মনোনীত রাসুলগণ। আল্লাহ তায়ালা তার আনুগত্যের সাথে রাসুলদের আনুগত্য ফরজ করেছেন এবং রাসুলের আনুগত্যের মাধ্যমেই কেবল আল্লাহর ভালবাসা প্রাপ্তি সম্ভব। আল্লাহর বাণী (হে নবী) তুমি বলো, “তোমরা যদি আল্লাহ তায়ালাকে ভালবাসো তাহলে আমার কথা মেনে চলো, আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের ভালবাসবেন এবং তিনি তোমাদের গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন, আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান’’,সূরা আল ইমরান ৩১। আল্লাহ তায়ালার দাসত্ব ও আনুগতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো হযরত মুহাম্মদ (সা:)। রাসুল (সা:) এর জীবনাদর্শের বাইরে মুক্তির কোন পথ খোলা নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং কোন অবস্থায়ই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরন করোনা; সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু” সূরা বাকারা ২০৮। হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে খন্ডিত ভাবে নয়, পরিপূর্ণরূপে মানতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ (সা:) মুমিনের জন্য আদর্শ। সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেই বুঝতে হবে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু শয়তানের অনসুরণ হয়ে যাচ্ছে। হযরত মুহাম্মদ (সা:) সকলের জন্য আদর্শ এবং তাঁকে মেনে চলার মধ্যেই রয়েছে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের কল্যাণ। কবির ভাষায়-
“সে কোন বন্ধু বলো; বেশী বিশ্বস্ত
কার কাছে মন খুলে দেওয়া যায়
কার কাছে সব কথা বলা যায়,
হওয়া যায় বেশি আশ্বস্ত
তার নাম আহমাদ বড় বিশ্বস্ত।
যে-জন কখনও ব্যথা দিতে জানে না
যে-জন কেবলই মুছে দেয় বেদনা
হৃদয়ের হাহাকার আপন করে নিতে কার বুক এত প্রশস্ত
তার নাম আহমদ বড় বিশ্বস্ত
মহানবী বলে তারে কেউবা ডাকে
আমি বলি প্রিয় তম,
সে আমার ধ্যান ভালবাসা প্রেম
মধুময় মনোহর স্বপ্ন সমর
যে জন করুণার অনুপম উপমা
যার মত দরদী কোথাও আর মিলে না
জীবনের আঙ্গিনায় আবাদ করে নিতে আর
কার বুক এত প্রশন্ত
তার নাম আহমদ বড় বিশ্বস্ত”
আহার নিদ্রা চলাফেরা একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে তার জীবনাচার সবই মুসলিম জাতির জন্য আদর্শ ও কল্যাণকর। তিনি ছিলেন আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা, আদর্শ প্রতিবেশী, আদর্শ শাসক, বিচারক, সেনানায়ক সকল ক্ষেত্রেই তিনি আদশ এবং তাকে মেনে চললেই সকলে উপকৃত হবে। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। তিনি তার উম্মতদের সতর্ক করেছেন, “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম”। স্বামী সম্পর্কে কেয়ামতের দিন স্ত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে, পাশাপাশি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তিনি নারীদেরকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, স্বামীর সংসারে স্ত্রীর জিম্মাদারী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নারীদের দায়িত্বও হালকা করে দিয়েছেন। নামাজ রোজাসহ মৌলিক ইবাদাত পালনের সাথে স্বামীর হুকুমপালনকারী স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন, সে যে দরজা দিয়ে খুশি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। ঐ স্ত্রী উত্তম যে স্ত্রীকে দেখে স্বামী প্রশান্তি লাভ করে। রাসুল (সা:) পিতা হিসেবে ছিলেন অনন্য। তার পুত্রসন্তানগণ শৈশবেই ইন্তেকাল করেন, মেয়েদের তিনি ¯েœহ মায়া, মহব্বত ও আদর দিয়ে গড়ে তোলেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি তার কন্যাদের প্রতি সদাচরণ করবে, ভালভাবে মানুষ করবে ও সৎপাত্রে পাত্রস্থ করবে, কেয়ামতের দিন তার ও আমার অবস্থান হবে একত্রে। একজন উত্তম প্রতিবেশী হিসেবে নিজে যেমন ছিলেন উদাহরণ তেমনই সকলকে উত্তম প্রতিবেশী হওয়ার তাগিদ প্রদান করেছেন। রাসুল (সা:) বলেছেন, “ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়” তিনি আরও বলেন “প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে উদরপুর্তি করে খাওয়া মুমিনের পরিচয় নহে।” আমাদের কর্মচঞ্চল এ জীবনে আহার, নিদ্রা, পেশাব-পায়খানা, অজু-গোসলসহ সার্বিক কার্যক্রমে অর্থাৎ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সামগ্রিক জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল (সা:) নির্দেশনা প্রদান করেছেন। রাসুল (সা:) পারস্পারিক সাম্য-সংহতি, মানবিক প্রেম প্রীতি, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল সমাজ কায়েম করে এমন এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যেই সমাজ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছে সে কথা স্মরণ রেখো, তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন, ফলে তার অনুগ্রহ ও মেহেররবানীতে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেছো। হযরত মুহাম্মদ (সা:) রাষ্ট্র পরিচালনায় অমুসলিমদের অধিকার সুনিশ্চিত করেছেন। অদ্যবধি কেউ রাসূল (সা:) এর যুগে অমুসলিমদের অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে এমন নজির পেশ করতে পারেনি। রাসুল (সা:) বিচার বিভাগে মুসলিম-অমুসলিম, ধনী-দরিদ্র, অভিজাত-নি¤œশ্রেণি, নর-নারী, আত্মীয়-অনাত্মীয় কোন ভেদাভেদ ছিলনা। রাসুল (সা:) যেমনই ছিলেন সমর নায়ক, সমাজ সেবক, রাষ্ট্রনায়ক, ধর্মীয় নেতা তেমনই ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রধান বিচারপতি। তিনি কবি না হয়েও কবি ও সালিন কবিতাকে পছন্দ করতেন। সত্যভাষী কবিদেরকে উৎসাহ দিতেন, কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। আব্বাস বিন মিরসাদ এর কবিতা পাঠে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাকে নিজের চাদর উপহার দিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর অর্থ ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন হয়ে মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র আধুনিক ও কল্যাণ রাষ্ট্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যা বিশ্বব্যাপী এখনও রোল মডেল এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ অর্থ ব্যবস্থা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। সর্বোপরি মানব জীবনের সার্বিক কল্যাণে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে রাসুল (সা:) এর আদর্শ বাস্তবায়ন করলে সুখি সমৃদ্ধশালী সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠবে, মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত হবে কল্যাণময়।
লেখক-
প্রভাষক,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি।
পারুয়ারা আবদুল মতিন খসরু কলেজ।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com