সংবাদপত্র ভীষণ টানে

।। মতিন সৈকত ।।
কৈশোরে কবিতার প্রেমে পড়েছি। কবিতা ভীষণ ভালোবাসি। গল্প উপন্যাস জীবনী গ্রন্থও টানে। রেডিও, টেপরেকর্ডার বাড়িতে ছিল। বড় ভাই এবং বাবা দুজনেই সংবাদ শুনতেন। বাংলাদেশ, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, বেইজিংসহ নানা দেশের সংবাদ। আমি সংবাদের পাশাপাশি রেডিও ম্যাগাজিন শুনতাম। তখন আমাদের বাড়িতে টেলিভিশন ছিলনা। গৃহ শিক্ষকের ও ব্যাক্তিগত রেডিও ছিল। রেডিও শোনার পাশাপাশি কল্পনার চোখে সে অনুষ্ঠান উপস্থাপন উপভোগ করেছি।
আমার বাবা এবং বড় ভাই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন। আলমারি ভর্তি বই ছিল। বাবা শুয়ে বসে শুরু করে বুকের উপর বই রেখে পড়তেন কুরআন, হাদিস, ইসলামি সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি। ঘরে সাঁটানো বিশ্ব মানচিত্র দেখে মুসলিম বিশ্বের অবস্থান নির্ণয় করতেন। দৈনিক পত্রিকার ষোলআনা পড়তেন। পত্রিকা পড়ার জন্য রায়পুর অথবা ইলিয়টগঞ্জ চলে যেতেন।
বাবা স্বশিক্ষিত, উদার, মুক্তমনা, সাহসী এবং ধার্মিক ছিলেন। বাবার পড়া কুরআন হাদিসের কাহিনী আমাদেরকে মুগ্ধ করত। ভাই ছিলেন প্রিন্সিপ্যাল। তিনি অনলবর্ষী বক্তা, সংগঠক, লেখক। তাঁর লেখা বই প্রকাশিত হয়েছে।
সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার সাথে স্কুলে পড়াকালীন যুক্ত হই। কবিতা লেখার চেষ্টা করি। পড়ি, লেখি, ছিঁড়ি। বারবার চেষ্টা করে যুতসই কবিতা বানাতে পারছিনা। অদম্য উচ্ছাস আগ্রহে লেগে থাকি। কিন্তু কাঙ্খিত কবিতা সৃষ্টি হচ্ছে কৈই? ভালোবাসা বলে কথা। লেখেছি প্রচুর।
কবিতা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রকাশ হচ্ছে সংবাদপত্র। সাহিত্য ভালবেসে সংবাদপত্র ভালবেসেছি। আমার বাবা ১,১,১৯৮৪ সালে আদমপুর স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ৮৬/৮৭ সালের দিকে মাদ্রাসার মুখপত্র হিসেবে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা যাত্রা শুরু করে। তখন মাদ্রাসাগুলোতে ইনকিলাব পত্রিকা রাখা একরকম বাধ্যতামূলক ছিল। দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা ডাকযোগে আমাদের বাড়িতে পৌঁছত।
ভারত দূতাবাসের ভারত বিচিত্রা, সোভিয়েত ইউনিয়নের উদয়ন, ইরানের নিউজ লেটার পোস্ট অফিসের মাধ্যমে
আমার নামে আসত। স্থানীয় পোস্ট মাস্টার এবং ডাকবিলিকারী ব্যক্তিও আমার পছন্দের মানুষ ছিলেন সংবাদপত্রের সৌজন্যে। মাঝেমধ্যে সাহিত্য সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। ডাকযোগ বিভিন্ন সংকলন এবং সাময়িকী আদান-প্রদান হত। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে লেখা পাঠাতাম।
সংবাদপত্রের লোকজন আমার স্বজন। তাঁদেরকে আমি ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। যিনি সংবাদপত্র বিলি করেন তিনিও আমার প্রিয়জন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনার সময় গল্প কবিতার চর্চা শুরু। এসএসসি পরীক্ষার পরে ১২টি কবিতা দিয়ে কবিতা পত্র প্রকাশ করি। সে সময়ে আমি কবিতা লেখার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন পত্র পাই। প্রথম সংকলন কবিতা পত্রে রাষ্ট্রপতির চিঠি সহ প্রকাশ করি। জাতীয় কবির ভাষায়।
‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে –
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।’
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ছাপাই ৩৩টি কবিতা দিয়ে আরেকটি কাব্য গ্রন্থ অলংকার। সে সময়ে অলংকার নামে সাময়িকী এবং দেয়াল পত্রিকা বের করতাম। শিকড়ের সন্ধানে নামেও দেয়ালিকা সম্পাদনা করেছি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত কৈশোরের লেখা নিয়ে পরবর্তীতে গল্প গ্রন্থ মুক্তি চাই, তোমরাতো সুখেই আছো প্রকাশ করি। আশির দশকের মাঝামাঝি এবং নব্বরইর দশকে বাংলা এবং ইংরেজি নববর্ষ, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরে, দুই ঈদে জাতীয় দৈনিকের বিশেষ সংখ্যার জন্য ছুটে যেতাম বাড়ি থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে দাউদকান্দি ফেরিঘাটে পত্রিকা সংগ্রহের জন্য। সেখানে হকার থেকে বেছে বেছে অনেক পত্রিকা কিনতাম। বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে চান্দিনা থেকেও অনেক দিন পত্রিকা কিনতে গিয়েছি।
৮৯তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে পত্রিকার জগতের সাথে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়।
পত্রিকার অফিস ছিল আমার কাছে যাদুঘরের মত। জ্ঞান- বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির মুখপত্র। নব্বই দশকে প্রচুর লেখেছি। মানুষ আয়নাতে যেমন নিজের চেহারা দেখে তেমনি ঢাকার দেয়ালে সাঁটানো পত্রিকায় নিজের লেখা দেখেছি। সে সময়ে আমার দুটি উপন্যাস আম্মা এবং চোখ ধারাবাহিকভাবে দৈনিক সমাচার এবং দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তখন আমার লেখা অর্ধ শতাধিক ছোটগল্পসহ অনেক কবিতা, ফিচার, কৃতিজনের জীবনী জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।
লেখতে হলে পড়তে হয়। সংবাদপত্রের চেয়ে উত্তম পড়ার মাধ্যম আর নেই। সংবাদপত্র একের ভিতর অনেক। সংবাদপত্রের দোকানগুলো অনেক টানে। একদিকে পড়া যায় অন্যদিকে সংগ্রহে রাখা যায়। পত্রিকা কিনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। পত্রিকা কিনার সময় ক্রোড়পত্র, ফিচার, সাহিত্য, ভ্রমণ, তারুণ্য, উদ্ভাবনী নিউজগুলো খেয়াল করি। বেড়াতে গেলে আঞ্চলিক পত্রিকা সংগ্রহ করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন পাবলিক লাইব্রেরির সাথে ছিল নিবিড় বন্ধত্ব। সংবাদপত্রের অনেক বান্ডিল ঘেটেঘুটে দেখছি। পত্রিকার অফিসগুলো বিকেল থেকে নিশিরাত রাত পর্যন্ত চলে কর্মযজ্ঞ। সাহিত্য সম্পাদকের টেবিলে বসে থাকতে থাকতে রাত গভীর হয়ে যেত। আড্ডা শেষে আস্তানায় ফিরে অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে। রাত গভীরে পত্রিকা অফিস থেকে বেরিয়ে ঢাকার রাজপথে একা। কুকুরের উৎপাতে ভয় পেতাম। আরো নানারকম উপদ্রুবের আশংকা থাকত। গাড়ি শূন্য সড়কগুলো মনে হত একেকটি নদী। রাত গভীরে রিকশা ভাড়া বেড়ে যেত। রাতের পরীদের ভয়ে দ্রুত পথ চলতে হত। রিকশা বিকল্প নেই। পত্রিকার নেশা আরেক ভয়াবহ নেশা। পত্রিকা ছেড়ে দিয়েছি। ঢাকা ছেড়ে দিয়েছি। নব্বই দশক থেকে পত্রিকায় আধুনিক কম্পিউটার যুক্ত হয়। তখনও সম্পাদকসহ বিভাগীয় সম্পাদকের আর্থিক অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। সংবাদপত্রের প্রেমে পড়ে-ই তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। ভালোবাসি সংবাদপত্র। এখন ভালো সংবাদপত্রে ভালো উপার্জন। বড় সম্মাননাসহ পরিবহন এবং আবাসন। সংবাদপত্রের লোকজন ভালো থাকুক। ভালো সম্মাননা পাক।
ভালোবাসি সাপ্তাহিক আমোদ। ইউনেস্কো স্বীকৃত আঞ্চলিক পত্রিকা। সাত দশকের পত্রিকা। সত্তরের শিরোপা পড়েছে। কুমিল্লাকে মাথায় তুলে রেখেছে। সাপ্তাহিক আমোদ সংবাদকর্মী তৈরির কারখানা। সাংবাদিকদের আদর্শ বিদ্যপীঠ। মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর প্রতিষ্ঠিত আমোদ তাঁর স্ত্রী শামসুন্নাহার রাব্বির হাত ধরে মহিরুহে পরিণত হয়েছে। ছেলে বাকীন রাব্বী’র তত্ত্বাবধানে সৌন্দর্য মণ্ডিত হয়েছে।
মহিউদ্দিন মোল্লার শ্রদ্ধা ভালোবাসায় এগিয়ে চলছে। ইতিহাস ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা বড় কঠিন। কঠিন কর্মটি যারা এগিয়ে নিচ্ছেন তাদেরকে স্যালুট।
লেখক, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় পরিবেশ পদকসহ দুইবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত।