অদু মামার স্মৃতি

।। বাকীন রাব্বী ।।
আমার মামার বাড়ি নগরীর বাগিচাগাঁও। সেখানকার সবাই আমার মামা, আমি সবার ভাগ্নে। এ বিষয়টা শুধু আমার জন্য না বাংলাদেশের সব ভাগ্নেদের জন্যই প্রযোজ্য। মামার গ্রামের সবাই মামা হয়ে যায়। বাগিচাগাঁও এলাকায় আমার এমন একজন মামা ছিলেন নাম আবদুল ওয়াদুদ। ডাকতাম অদু মামা। তিনি ময়নামতি সুতা কলের হিসাব শাখায় কাজ করতেন। ময়নামতি সুতাকল বন্ধ হওয়ার পর সবার মতো অদু মামাও বেকার হয়ে গেলেন। তিনি নিয়মিত আমোদ-এ আসতেন, আমাদের সাথে সময় কাটাতেন। আমার সহকর্মী শাহাজাদা এমরান,মহিউদ্দিন মোল্লা,আবদুল্লাহ আল মামুন,এইচ এম সিরাজ,ফজলে রাব্বীসহ সবাই মামার সাথে খুব মজা করতো। মামাও সবার খোঁজ খবর রাখতেন, সবাইকে আদর করতেন। আমোদ-এ এসে মামা আমাকে ডাকতেন এমডি সাহেব। শাহাজাদা বেশি দুষ্টামি করলে তাকে ভয় দেখাতেন- এমডি সাহেবকে বলে তোমার বেতন কাটাবো। আমি তোমার সুযোগ সুবিধা কমাবো ইত্যাদি ইত্যদি। শাহাজাদাও প্রতি উত্তরে বলতো- আমি নিজেই আর আপনার এমডি সাহেবের চাকুরি করবো না, চলে যাচ্ছি আগামী মাস থেকে। প্রতি বুধবার আমোদ প্রকাশের আগের দিন দুপুরে আমরা এক সাথে অফিসে খেতাম। মামাকে বলা ছিল তিনি যেন প্রতি বুধবার দুপুরে আমাদের সাথে খেতে আসেন। উনি চেষ্টা করতেন প্রতি বুধবারই আসতে। কখনও যদি শাহাজাদা ব্যস্ততার জন্য দুপুরে খেতে না আসতো, তাকে ফোন করে আনাতেন। মাঝে মাঝে বলে দিতেন আসার সময় যেন দই নিয়ে আসে।
মামার বাসা যেহেতু বাগিচাগাঁও, রেল স্টেশনে ছিল তাঁর আধিপত্য। স্টেশনে কর্মরত, শুধু স্টেশনে না, রেলওয়ের টিটি, লোকো মাস্টার, গার্ড সবার সাথেই ছিল তাঁর ঘনিষ্ট পরিচয়। প্রতিটা ট্রেনের খোঁজ তিনি জানতেন। স্টেশনে অদু মামার কতটা প্রভাব একটা ঘটনা বললে বুঝা যাবে। ১৯৯১ সালে আব্বা অসুস্থ অবস্থায় ট্রেনে করে ঢাকা যাচ্ছেন। আম্মা ও ছোট বোন তারিকা রাব্বী আছে সাথে। আমি এসেছি তাঁদের উঠিয়ে দিতে। আমরা সবাই জিআরপি থানার সামনে আম গাছটার নিচে দাঁড়ানো। হঠাৎ অদু মামা আব্বাকে দেখলেন লাঠি ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কাছে এসে বললেন- আরে দুলাভাই আমরা স্টেশনে থাকতে আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন? এ কথা বলেই জিআরপি থানা থেকে একটা হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার এনে আব্বাকে বসালেন। আম্মাকে বললেন- আপা, আপনার জন্য একটা চেয়ার আনবো? আম্মা ধমক দিলেন মামাকে। কি বেমানান লাগছিল আব্বাকে। প্ল্যাট ফর্মে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে তিনি বসে আছেন। চেয়ারে বসিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, এবার জানতে চাচ্ছেন তাঁর দুলাভাই কি খাবেন চা, কোক, কলা বিস্কুট কোনটা? আব্বা শুধু বললেন, একটু পানি খাবেন। আবার দৌড় দিলেন জিআরপির থানার ওসির পানির জগ আনেত। গ্লাস এনে নিজ হাতে টিউবয়েল চেপে পানি এনে সবাইকে খাওয়ালেন। আমাদের মধ্যে কারোর ট্রেনের টিকেটের প্রয়োজন হলে ভরসা ছিলেন মামা। মামা চাইতেন আমিও যেন সবসময় নিজের গাড়ি রেখে ট্রেনে ভ্রমণ করি।

অদু মামার সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তিনি শহরে প্রচুর হাঁটতেন। বিনা প্রয়োজনে কখনোই রিক্সায় উঠতেন না। তিনি এমন হাঁটার পাগল ছিলেন বললে অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কি কাজে যেন মামা একবার লাকসামের নাওটি স্টেশনের কাছে গেছেন। ফেরার পথে ট্রেনে চড়ে ফিরবেন। লোকাল ট্রেনে করে আসবেন লাকসাম, সেখান থেকে অন্য ট্রেনে কুমিল্লা। পূর্বাঞ্চলের সব ট্রেনের খবর তিনি জানেন, কোন ট্রেন কোথায় কখন আসবে। লোকাল ট্রেনটা আরও প্রায় দুই ঘণ্টা পর নাওটি পৌঁছাবে। এ দুই ঘণ্টা তিনি নাওটি বসে না থেকে ৭/৮ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে লাকসাম এসে অন্য ট্রেন চড়ে কুমিল্লা আসেন।
যখনই তিনি মাইকে কোন শোক সংবাদ শুনতেন, কান খাড়া করে মনোযোগের সাথে শুনতেন নামাজে জানাযা কখন, কোথায় হবে। পরিচিত অপরিচিত যারই নামাজে জানাযা হোক তিনি সময় মত সেখানে উপস্থিত হতেন। অধিকাংশ সময়ে লাশ দাফন করে বাড়ি ফিরতেন। যে কারও নামাজে জানাযা পড়াকে মামা দায়িত্ব হিসাবে নিতেন। সব ট্রেনের সময় সূচির সাথে তিনি আরও একটা সময় সূচি জানতেন, তা হল শহরের কোন মসজিদে কোন ওয়াক্তের নামাজের জামাত ক’টায় হয়। জামাত ছাড়া কখনও তিনি নামাজ পড়তে চাইতেন না। বাগিচাগাঁও মসজিদে অনেক বছর রোজার সময় তিনি একা এতেকাফে বসছেন।
অদু মামারা সাতভাই, তিনি সবার বড়। তাঁর ছোট ভাইয়েরাও আমাকে যথেষ্ট সম্মান করেন। তাঁদের একটা পৈত্রিক রেস্টুরেন্ট আছে স্টেশন রোডে। সব ভাইয়েরা এখানে পালা করে বসেন। মামা বসতেন দোকান খোলার সময় ফজরের নামাজের পর। আমাদের সম্পর্কটা এমন আত্মিক ছিল যে, বলে বুঝানো যাবে না। আমি অসুস্থ্য হলে মামাকে দেখলে ভালো বোধ করতাম। মামার বেলায়ও ঠিক তাই হতো। মামার নিজের কোন মোবাইল ফোন ছিল না। এতে তাঁর কোন অসুবিধাও হতো না। অসুবিধা হতো অন্যদের তাঁকে খুঁজে পেতে। আমার নম্বরটা মামার মুখস্ত ছিল। যে কোন প্রয়োজনে যে কারো ফোন নিয়ে কল করতেন এবং প্রয়োজনীয় কথাটা বলে এক মিনিটের মধ্যেই ফোন রেখে দিতেন। মামার দোকানের একটা ছেলে, নজরুলের ফোন থেকেই তিনি আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করতেন। খোঁজ খবর নিতেন, দিতেন। আমারও কোন প্রয়োজন হলে নজরুলকেই বলে রাখতাম, মামা দোকানে এসে ফোন করতেন।
একবার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম গেলাম। যেহেতু ট্রেনে যাব, মামাকে নিলাম সাথে। অনুষ্ঠানে মামা যেতে পারবেন না, আমি দুইটা ফোন নিয়ে নিয়েছি একটা মামার কাছে থাকবে প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যাবে। কোয়ান্টাম চট্টগ্রাম সেলের পাশেই একটা মসজিদ আছে, যা মামার প্রিয় জায়গা। দ্বিতীয় ফোনটা ভাইব্রেশন মোডে রেখে মামাকে বুঝিয়ে দিলাম ফোন কেঁপে উঠলে এভাবে ফোন ধরবেন। আমি চলে গেলাম অনুষ্ঠানে, মামা মসজিদে ঢুকে গেলেন। ঘণ্টা দুয়েক পর অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে মামাকে কল করলাম একবার, দুইবার, তিনবার। তিনি ফোন ধরছেন না। ভয় পেয়ে গেলাম, আবার ভাবলাম হয়তো মসজিদে ঘুমাচ্ছেন। ভয়ে ভয়ে মসজিদের দিকেই গেলাম। দেখি তিনি আসন ধরে বসে কোরআন শরিফ পড়ছেন আর তার ঢিলেঢালা প্যান্টের পকেটে ফোন ঝুলছে, ফোনের কাঁপনি উনি টের পাচ্ছেন না।
২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে মামার শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। আগের মত জোরে হাঁটতে পারেন না। মাঝে মাঝে বুকে হালকা ব্যথা অনুভব করেন। নিয়ে গেলাম তৃপ্তিশ দা’র কাছে। বিস্তারিত বললাম। তৃপ্তীশ দা’ একটি ইটিটি করার পরামর্শ দিলেন। ঢাকা যাওয়া হয়নি, সেটাও আর করা হয়নি। অগাস্টের ১৮ তারিখ বেলা ৪টার দিকে মামার দোকানের সেই নজরুল ফোন করে জানালো, আপনার মামা মারা গেছেন। মামার দাফন কাফনের পর দু’বছর আমি বাগিচাগাঁও বা রেল স্টেশন যাইনি, যেতে পারিনি। অদু মামা চলে যাবার আজ পঞ্চম বছর।

লেখক: সম্পাদক,সাপ্তাহিক আমোদ।