তৈয়বুর রহমান সোহেল।।
২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। ঢাকায় তীব্র আন্দোলন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের মুখে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে কোটা পুরোপুরি বিলুপ্ত করেন। সংস্কারের নামে সেখানে ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। এ ফাঁকির কথা লিখব আরেকদিন। ২০২৪ সালের ৫জুন সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালের কোটা সংস্কারে সরকারের পরিপত্রকে বাতিল ঘোষণা করে।
রায় বাতিল ঘোষণার তিন-চারদিন পর থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। প্রতিদিন অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী মহাসড়কে অবস্থান নিতো। মহাসড়কের পশ্চিমে একটি নির্মাণাধীন ভবনের নিচে আড্ডা-গল্পে সময় কাটাতেন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ম্যাজিস্ট্রেটরা। মহাসড়কের দুই পাশে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সরব উপস্থিতি থাকতো। কিন্তু ছাত্রদের বাধা দিতো না। একদিন-দুইদিন করে আন্দোলন চলতে থাকে নির্বিঘেœ। ১১ জুলাই কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয় থেকে মহাসড়ক দখলের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীরা বের হলে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। পুলিশ ছাত্রদের মারধর ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি মোড় নেয় উল্টোদিকে। সারাদেশে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন তীব্রতর হতে শুরু করে। ওইদিন সন্ধ্যায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়িতে অবস্থান নেয়। প্রায় একমাস পর এমন পরিস্থিতিকে সত্যিকার আন্দোলন বলে মনে হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রতিদিন নতুন নতুন কর্মসূচি আসতে থাকে। সরকার হার্ডলাইনে যায়। সে সাথে মারমুখী অবস্থান নেয় এমপি বাহারের পালিত সন্ত্রাসীরা। ছাত্ররা নতুন কর্মসূচি দেয়, সেখানে হামলে পড়ে বাহারের লোকজন। শুধুমাত্র ছাত্ররা তার সন্ত্রাসীদের বাধার মুখে পড়েনি, শিক্ষক-সাংবাদিক কেউ তাদের রোষানল থেকে বাদ পড়েনি। আমি নিজে পাঁচবার বাহারের পালিত সন্ত্রাসীদের রোষানলে পড়ি। সে দিন বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কর্মসূচি ছিল। বাহারের সন্ত্রাসীরা মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়। কোটবাড়ি হয়ে বিশ^বিদ্যালয় যাওয়ার পথে সহকর্মী সুমনসহ আমাকে একরকম অবরুদ্ধ করে সন্ত্রাসীরা। তাদের অনেকের হাতে ছিল শটগান। সুমনকে বারবার চেক করে। সাংবাদিক পরিচয়েও কাজ হয় না। বরং আরও হিং¯্র হয়ে ওঠে। ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে আমরা উল্টোপথে হাঁটতে বাধ্য হই। ১৬জুলাই আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার দিনে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী মহাসড়কে অবস্থান নেয়। ওইদিন আন্দোলন তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও দুইঘণ্টা পর আচমকা বিকেল ৫টায় কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। এরই মধ্যে ১৭জুলাই সুনসান নীরবতা চোখে পড়ে। ১৭ জুলাই রাতে মুঠোফোনের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮ জুলাই প্লাবনের বেগে শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে অগ্রসর হতে থাকে। পুলিশ বিভিন্ন পয়েন্টে বাধা দিলেও তা কার্যকর হয় না। গোপন সূত্রে জানতে পারি, ওইদিন ছাত্রদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। দুপুর ১টায় মহাসড়কে অবস্থান নেওয়াদের একজন পুলিশকে উদ্দেশ্য করে লাঠি ছুঁড়ে মারলে পুলিশ গুলি ছোড়া শুরু করে। পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়। টানা পাঁচ ঘণ্টার সংঘর্ষে সেদিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। সন্তান গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে একজন মা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ছাত্রদের দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করলে ছাত্ররা মহাসড়ক ছেড়ে দেয়। এরই মধ্যে সাবেক সিটি মেয়র সূচনার নেতৃত্বে এমপি বাহার বাদে আওয়ামী লীগের প্রায় সব শীর্ষ নেতা অস্ত্র হাতে মহাসড়কের দিকে যাত্রা করে। সহকর্মী মারুফসহ বাসায় ফেরার পথে অস্ত্রধারীরা আমাকে ডাক দেয়। সেদিন আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেন। ২ আগস্ট। আবু সাঈদের পর সারাদেশে তখন সারাদেশে অসংখ্য ছাত্র-জনতা শহীদ। কারফিউ-ইন্টারেনেট বন্ধসহ ফ্যাসিবাদী সরকারের ধৃষ্টতা আকাশচুম্বী। ওইদিন জিলা স্কুল থেকে কর্মসূচি ছিল। এমপি বাহারের পালিত সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে মোড়ে মোড়ে। অন্তত ৫০০ লোকের হাতে শটগান। ছাত্রদের ওপর সকাল থেকে চড়াও হয় তারা। অন্তত পাঁচজন কথিত সাংবাদিক বাহার ও সূচনার কাছে তথ্য পাচার করে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকরা রোষানলে পড়েন। দুর্ধর্ষ স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা রিন্টু, যুবলীগ নেতা সহিদ, কাউন্সিলর শিপন, জাবেদদের আগ্রাসী ভূমিকায় দেখা যায়। তারা পথে পথে ছাত্রদের কুপিয়ে ও গুলি করে আহত করেন। পুলিশ লাইনে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি করা হয়।
৪ আগস্ট সহকর্মী সুমন, মারুফসহ দুইবার সন্ত্রাসীদের তোপের মুখে পড়ি। টমছমব্রিজে অবস্থান নেওয়া সন্ত্রাসীরা আমার মুঠোফোন কেড়ে নেয়। দৌলতপুরে কোতোয়ালি থানার ওসি ফিরোজ হোসেনকে দেখা যায়। কোটবাড়ি বিশ্বরোড তখন সন্ত্রাসীদের দখলে। সবার হাতে দেশীয় অস্ত্র, শটগান রিভলবার। আমরা বাধা পেয়ে ক্যান্টনমেন্ট চলে যাই। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় দুই যুবলীগ নেতা ছাত্রদের গুলি করতে করতে সামনে অগ্রসর হয়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী সাঁজোয়াযান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ছাত্ররা সাঁজোয়াযানে উঠে উল্লাস করে। দুটি সাঁজোয়াযান আলেখারচর বিশ^রোডে গিয়ে সন্ত্রাসীদের ওপর ফাঁকা গুলি ছোড়ে। বিকেলে মহাসড়ক ছাত্রদের দখলে চলে যায়।
৫তারিখ মাহেন্দ্রক্ষণ। লংমার্চ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে দেওয়া হয়। কুমিল্লায় মনে হচ্ছিল কঠিন কারফিউ চলছে। এরই মাঝে ইন্টারনেট বন্ধ। মহাসড়ক থেকে বাসায় ফিরি। বিদ্যুৎ নেই। এরই মাঝে এক ভাতিজা ফোন করে জানায় কুর্মিটোলা থেকে বিশেষ প্লেন ছেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ আসার পর চারিদিকে হর্ষধ্বনি আর উল্লাসের শব্দ। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ।
লেখক:কুমিল্লা প্রতিনিধি,বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড,বাংলানিউজ ও প্রতিদিনের বাংলাদেশ।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com