আমরা স্রোত অতিক্রম করবো

মনোয়ার হোসেন রতন।।

গাজামুখী মানবতার এক অদম্য নৌযাত্রা
আমরা অনেকেই যেতে পারিনি। আমি নিজেও যেতে পারিনি। কিন্তু এই যাত্রার স্রোত পেরিয়ে, হৃদয়ের গহীনে যে ঢেউ উঠেছে, তা থেকে দূরে থাকা যায় না। ২০২৫ সালের শেষভাগে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ এক হলো গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার পতাকার নিচে—উদ্দেশ্য একটাই: অবরুদ্ধ গাজার মানুষদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া, এবং সেই সাথে অবরোধের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ।
এই প্রবন্ধে আমি তুলে ধরছি সেই নৌযাত্রার শুরু থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ইতিহাস, তার প্রতিকূলতা, প্রতিরোধ এবং মানুষের সাহসিকতার এক অনন্য অধ্যায়।
স্বপ্নের সূচনা: সুমুদের ডাক
“সুমুদ” আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘অটল থাকা’, ‘ধৈর্যধারণ’। এই নামেই গঠিত হয় গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা, একটি আন্তর্জাতিক মানবিক নৌযাত্রা, যেখানে অংশগ্রহণ করেন চিকিৎসক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাধারণ নাগরিক—সবাই এক উদ্দেশ্যে: গাজার জনমানুষের পাশে দাঁড়ানো।
২০২৫ সালের আগস্ট মাসে বার্সেলোনা থেকে যাত্রা শুরু করে এই বহর। এরপর তিউনিসিয়ার বিজার্তে বন্দরে এসে একত্রিত হয় কয়েক ডজন নৌযান। ৪৪টি জাহাজ ও প্রায় ৫০০ জন যাত্রী নিয়ে গঠিত হয় এই মানবিক বহর—বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিত্ব ছিল এখানে। প্রত্যেকে জানতেন, এই যাত্রা শুধুই মানবিক সহায়তা নয়—এ এক নৈতিক যুদ্ধ।
বিপদের মাঝেও এগিয়ে যাওয়া
এই যাত্রা সহজ ছিল না। শুরু থেকেই বাধা আসে। তিউনিসিয়ার উপকূলে ড্রোন হামলা হয় ‘Alma’ ও ‘Family’ নামক দুটি জাহাজে। যদিও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি, তবুও এটি ছিল একটি প্রতীকী হুমকি।
যাত্রাপথে আসে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ—বাতাস, ঢেউ, যান্ত্রিক ত্রুটি। কিন্তু অভিযাত্রীরা থামেননি। তারা জানতেন, একটি শিশু যদি গাজায় ক্ষুধায় কাঁদে, তাহলে শত ঝড় পেরিয়েও তার পাশে দাঁড়াতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এই অভিযানকে সমর্থন জানান বহু সংস্থা ও রাষ্ট্র, এমনকি বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও বিবৃতি আসে এই উদ্যোগের পক্ষে।
ইসরায়েলি প্রতিরোধ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সমস্ত নৈতিক উচ্চতা থাকা সত্ত্বেও, ইসরায়েল এই বহরকে গ্রহণ করেনি। বরং একে “উসকানি” হিসেবে চিহ্নিত করে। আন্তর্জাতিক জলসীমা পেরিয়েই একে একে ৪১টি জাহাজ আটক করা হয়, যাত্রীদের জোর করে আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়।
এটি ছিল আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শান্তিপূর্ণ মানবিক সাহায্য পাঠানোকে শত্রুতা হিসেবে দেখা হয়েছে, এবং ফ্লোটিলার যাত্রীদের সঙ্গে আচরণ হয়েছে যুদ্ধবন্দির মতো।
বিশ্বজুড়ে এর প্রতিবাদ শুরু হয়। আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রেড ক্রস সহ বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্র এই অভিযানের প্রতিরোধকে নিন্দা করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়, “Let Gaza Live”, “Break the Siege”—এই স্লোগানে ছেয়ে যায় বিশ্বমানচিত্র।
একটি প্রতীকী জয়
যদিও অধিকাংশ জাহাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, ‘Marinette’ নামের একটি জাহাজ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গাজার উপকূলের দিকে এগিয়ে ছিল। এর অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও এটি একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়—যে কিছুই থামাতে পারে না মানবতার বহরকে।
এই নৌযাত্রা সফল হোক বা ব্যর্থ—এর প্রতিটি ঢেউয়ে লেখা হয়েছে এক মানবিক প্রতিরোধের কবিতা। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল, যা বলে: “তুমি যদি নিরস্ত্র থেকেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারো, তবে সেটিই সবচেয়ে বড় অস্ত্র।”
আমরা যারা যেতে পারিনি…
এই লেখাটি সেইসব মানুষের পক্ষ থেকে, যারা যেতে পারেনি, কিন্তু অন্তরে অন্তরে গিয়েছিল। আমি ছিলাম না কোনো জাহাজে, হাতে ছিল না পতাকা, পায়ে ছিল না সামুদ্রিক জল। কিন্তু আমার কলম জানে, হৃদয় কাঁপে, চোখ ভিজে ওঠে—যখন দেখি, কিছু মানুষ এখনো আছেন, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বেছে নেন ন্যায়ের পাশে দাঁড়াতে।
তুমি যেতে পারোনি, আমিও না। কিন্তু এই যাত্রা আমাদের সকলের—আমরা যারা বিশ্বাস করি, বাড়ির ধ্বংসের মাঝেও শিশুর হাসি ফিরে আসতে পারে, যদি কেউ ভালোবাসা নিয়ে পৌঁছে যায়।
স্রোত পেরোনোর অনুপ্রেরণা
এই প্রবন্ধে শুধু তথ্য নয়, হৃদয়ের গুঞ্জন আছে। কারণ এটি শুধুই একটি অভিযান নয়, মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর এক সর্বজনীন ডাক। আমরা যারা যাইনি, তারা এই গল্পটি ছড়িয়ে দিতে পারি, বলার শক্তি নিতে পারি, এবং নিজেদের আশপাশে সাহস ছড়াতে পারি।
আমরা স্রোত অতিক্রম করবো—এটি একটি শিরোনাম নয়, এটি একটি সংকল্প। একটি যাত্রা শেষ হতে পারে, কিন্তু এই চিন্তা চলতেই থাকবে:
যেখানে অন্যায়, সেখানেই প্রতিরোধ। যেখানে অবরোধ, সেখানেই মুক্তির স্বপ্ন। আর যেখানে গাজা, সেখানেই আমরা।