।। শিমুল মাহমুদ ।।
দেশের প্রাচীনতম বাংলা সাপ্তাহিক আমোদ প্রকাশনার ৭০ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে-এটি এক বিরল ঘটনা। পত্রিকাটির নেতৃত্ব এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে। দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সাধারণ মানুষের খবর প্রাপ্তি এখন অনেক সহজ হয়ে গেলেও এক সময় প্রকৃত খবরের জন্য পাঠকের যথেষ্ট আকুতি ছিল। সেই কঠিন সময়ে ১৯৫৫ সালে সাপ্তাহিক আমোদ জেলা শহর কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত হয় মরহুম মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর নিবিষ্ট সম্পাদনায়।
সাপ্তাহিক আমোদ গত শতাব্দীর শেষদিকে সফল আঞ্চলিক পত্রিকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এই পত্রিকার হাত ধরে দেশের অসংখ্য মেধাবী সাংবাদিকের জন্ম হয়েছে, যারা পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতিমান হয়েছেন। আমোদ ছিলো কুমিল্লা, চাঁদপুর ও সিলেটের একমাত্র আঞ্চলিক সাপ্তাহিক, যার জন্য সপ্তাহান্তে অপেক্ষায় থাকতো তার পাঠক।
সাপ্তাহিক আমোদ প্রকাশিত হতো বৃহস্পতিবার। কুমিল্লা শহরের অধিকাংশ দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফামের্সিতে এই পত্রিকা থাকতো টেবিলে টেবিলে। যে সপ্তাহে বৃহস্পতিবার কুমিল্লা শহরে যেতাম সেদিন এই অভূতপূর্ব দৃশ্য আমাকে অনেক আনন্দ দিতো। কলেজছাত্র হিসাবে এক সময় এই পত্রিকাটির সঙ্গে জড়িত হই। সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর সীমাহীন মমতায় তখন হাতে কলমে সাংবাদিকতায় দীক্ষা পাই। তখন সেই ’৮০-র দশকের শুরুতে কুমিল্লায় আলোচিত পত্রিকা বলতে অধ্যাপক আবদুল ওহাব সম্পাদিত দৈনিক রূপসী বাংলা এবং মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী সম্পাদিত সাপ্তাহিক আমোদ। এই সময়ে দেলোয়ার জাহিদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক সমাজকণ্ঠ, আফতাবুর রহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক ফলক, সমবায় ব্যাংকের মুখপত্র সাপ্তাহিক রংধনু কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলা থেকেও পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে। সবমিলিয়ে কমবেশি ৬০টি পত্রিকার নিবন্ধন রয়েছে এই জেলায়।
এক সময় কুমিল্লা ছিল শিল্প সাহিত্যের পথিকৃৎ জেলা শহর। সেই শহর থেকে ৭০ বছর আগে পাকিস্তান আমলে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশনা ছিল অনেক দু:সাহসের কাজ। সেই সময়ে শ্রদ্ধেয় সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী শুরুতে ক্রীড়াঙ্গনের কাগজ হিসাবে সাপ্তাহিক আমোদ প্রকাশ করেন। পরে সেটি সব ধরণের খবর প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠে। তখন অনেক পাঠকপ্রিয় ছিল সাপ্তাহিক আমোদ। ১৯৭৮-’৭৯ সালে স্কুলে পড়ার সময়ই আমি ডাকযোগে পত্রিকাটি পেতাম উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে বসে। সেই সুবাদেই ধীরে ধীরে খবরের কাগজের প্রেমে পড়ে যাই। নিউজপ্রিন্টের কাগজে ছাপা কালো হরফের প্রতি আলাদা টান অনুভব করি। কলেজে উঠেই পত্রিকাটির সংবাদদাতা হিসাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ মিলে। আমার গ্রামের বাড়িটি ছিল বুড়িচং উপজেলার পশ্চিমে, গোমতী নদীর তীর ঘেঁষা এক গ্রামে। নদী চলে গেছে সোজা, কিন্তু নদীর বাঁধটি ছিল হাঁসুলি বাকের মতো, প্রায় অর্ধ চন্দ্রাকৃতির। নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বিশাল এই বাঁধটি কোনো কাজে লাগতো না। অন্যদিকে বর্ষায় পানি বাড়লে ঝুঁকি বাড়তো বাধের পাড়ের মানুষের। এই অংশে একাধিকবার বাঁধ ভেঙে বিস্তৃত এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এই বাস্তবতায় আমি সেই বাধটি সোজা করার জন্য একটি রিপোর্ট লিখি সাপ্তাহিক আমোদ এর জন্য। রিপোর্টে বলা হয়, গোমতী নদীর ওই অংশের বাধটি নদী বরাবর সোজা করা হলে বিপুল পরিমাণ আবাদী জমি অবমুক্ত হবে। বাঁধের উপর দিয়ে যাতায়াতে সুবিধা পাবে সাধারণ মানুষ। সাপ্তাহিক আমোদে প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় সেই রিপোর্ট। ওই রিপোর্টের সূত্র ধরেই পরে গোমতী নদীর ওই অংশের বাঁধ সোজা করা হয়। সেই বাঁধ সোজা হওয়ার পর অবমুক্ত জমিতে এখন ফসলের অবারিত মাঠ। পত্রিকায় রিপোর্ট লিখে যে ফল পাওয়া যায় তখন সেটি আমার কাছে ছিল বড় চমক। তারুণ্যের সেই কাচা সাংবাদিকতার পাকা ফল দেখে আমি নিজেই তখন অনেক উদ্দীপ্ত। এরকম আরও অনেক ঘটনা আছে। সাপ্তাহিক আমোদ এ রিপোর্ট লিখে অতি দ্রুত তার প্রতিকার পাওয়া যেতো। হতে পারে সেই থেকেই সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল মনোভূমিতে। জয়তু সাপ্তাহিক আমোদ। আপাতত শতবর্ষের মাইলফলক পর্যন্ত টিকে থাকুক- প্রতিষ্ঠার দিনে শুধু এটুকুই প্রত্যাশা।
লেখক:বিশেষ প্রতিনিধি,বাংলাদেশ প্রতিদিন।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com