প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ৯:৩১ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ ডিসেম্বর ২৭, ২০২০, ১:৪৭ অপরাহ্ণ
আমোদ ডেস্ক।।
যশোরের অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল হুসেইন খান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) শরিফ মোহাম্মদ রুবেলের বিরুদ্ধে উপজেলা সহকারি প্রোগ্রামারকে যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। ইউএনও নাজমুল হুসেইন খান এর আগে কুমিল্লায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ভুক্তভোগী নারী কর্মকর্তা প্রতিকার চাইলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে হয়রানির শিকার নারীকেই বদলির আদেশ দিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতর। অথচ, বহাল তবিয়তে রয়েছেন ওই দুই কর্মকর্তা।
এর আগে, অভয়নগর উপজেলার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের ওই নারী কর্মকর্তা গত ২২ ডিসেম্বর মহাপরিচালক বরাবর কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও জীবননাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ দাখিল করেন।
অভিযোগে বলা হয়, গত ৪ মার্চ তিনি অভয়নগর উপজলায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের অফিসে যোগদান করেন। কিন্তু শুরু থেকে ইউএনও নাজমুল হুসেইন খান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তাকেসহ অন্য সহকর্মীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন।
এছাড়া অফিসের নির্ধারিত সময়ের পর গভীর রাত পর্যন্ত তাকে অফিসে থাকতে বাধ্য করেন। একপর্যায়ে তিনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শরিফ মোহাম্মদ রুবেলের মাধ্যমে তাকে কুপ্রস্তাব দেন। ইউএনওর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সর্বশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন। যে কারণে তিনি সম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে চাকরি করতে মহাপরিচালকের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঘটনার শিকার ওই নারী বলেন, “প্রথমে তাদের যৌন লালসার ইঙ্গিত বুঝতে পারিনি। পরে তারা সরাসরি সঙ্গ দেবার প্রস্তাব দেয়।”
তিনি বলেন, “প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইউএনও স্যারের হয়ে বলতেন- আমি কেন স্যারের হতাশা দূর করি না। এই হতাশা অন্য কোনও নারী মেটাতে পারে, স্ত্রী নয়। ইউএনও স্যার প্রশিক্ষণে যাওয়ার সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে সাথে পাঠাবেন। নির্দেশনা দেন, করোনা প্যান্ডামিকের সময় আমি যেন পিআইও'র সাথে মোটরসাইকেলে খুলনায় আসা-যাওয়া করি। আমরা দুজনই খুলনা থেকে অফিস করতে আসতাম। যেতে রাজি হইনি। তাছাড়া, মা-বাবা আমাকে নিতে আসতেন। স্যার একদিন বলেন, ওনাদের আসার কী দরকার। রাতে আপনাকে আকিজে সিট করে দিতে বলি। পিআইও, আমরা সবাই একসাথে না হয় থাকলাম। আমি প্রথম বুঝিনি আকিজ কী। পরে জানতে পেরেছি, আকিজ অফিসের পাশেই একটি সিটি। যেখানে হোটেলসহ অনেক কিছুই আছে। এ ধরনের অনেক নোংরা প্রস্তাব দেওয়া হতো।”
তিনি বলেন, “পিআইও ঈদের সময় আমাকে অনেককিছু কিনে দিতে চান। সেদিন তিনি আমাকে বলেন, একটা ডিল করা যাক- আপনি যখন হতাশ থাকবেন, তখন আমরা আপনার হতাশা কাটাবো। মানে, আমাদের টাকায় ঘুরলাম, শপিং করলাম, সিনেমা দেখলাম। আর আমরা যখন হতাশায় থাকবো, তখন আপনি আমাদের একটু সঙ্গ দেবেন। এরপর আমি তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাই।”
তিনি অভিযোগ করেন, “কাজের অজুহাতে আমাকে বিকেল ৫টার পরও অফিস থাকতে বাধ্য করা হয়। বিশেষ করে যখন অফিসে অন্য কেউ থাকেন না। গত ২২ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৫২ বাজে; আমি গুছিয়ে অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম। সে সময় পিআইও সাহেব আমাকে ফোন করে আমার অবস্থান জানতে চান। অফিসে আছি ও কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামীকালের জন্য একটা কাজ আজকেই করতে হবে। পাশে থেকে ইউএনও স্যার বলে দিচ্ছিলেন, দুপুর ১২টার মধ্যে লাগবে। এমনিতে আমাকে কাজের নামে অনেক প্রেশার দিয়ে রাখা হতো। আমিতো আমার চাকরি, আমার দপ্তরের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। সারাক্ষণ ইউএনও স্যারের কাজে ব্যস্ত রাখা হতো। সবশেষ আমি বললাম, ঠিক আছে আমি কাজটা করবো। কিন্তু আমাকে একটা জনবল দেন। ওটাতো কম্পিউটার অপারেটরের কাজ। জনবল চাইলে জয়নাল নামে একজনের কথা বলে। আমি বলি, জয়নালকে অ্যাসিস্ট করব যাতে উনি কাজটা করতে পারেন। তাছাড়া, আমার উপর আপনাদের অফিসের অনেক কাজের লোড রয়েছে। তখন পিআইও বলেন, ওকে কাজ দেখালে হবে না। আপনাকেই করতে হবে। আমি জানাই, আমাকে তো ফিল্ডে রাখা হয়েছে। আমি ফিল্ডে থাকি কি না তা তদারকি করা হয়। ৪০ দিনের কর্মসৃজনের কাজে প্রতিদিন মাঠে যেতে হয়; আবার বিকেল ৪টার মধ্যে ইউএনওকে রিপোর্ট করতে হয়। আমি ফিল্ডে না গেলে আমাকে শোকজ করা হবে, এ কাজ না করলে শোকজ করা হবে- আমি কই যাব?। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে মারপিট করে আমাকে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন। বলেন, তিনি খুলনার বড় রংবাজ। আমাকে দেখে নেবে। উনি আমাকে এভাবে বলতে পারেন না। আমি একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা আর পিআইও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। উনি মূলত ইউএনও স্যারের শেল্টারে এসব বলেন। কিছুক্ষণ পর ইউএনও স্যার পিআইওকে ফোন কেটে দিতে বলেন। এরপর ৫টা ৩ মিনিটের দিকে ইউএনও স্যারের অফিস থেকে একজন লোক একটা চিঠি নিয়ে এসে বললেন, আপনাকে থাকতে হবে। তখন আমি তালা দিয়ে অফিস থেকে বের হয়েছি। আমার সাথে আমার মা ছিলেন। তিনি বললেন ৫টার পরও থাকতে হবে। তখন ওই লোকটা বললেন, কী করবো আমরা তো হুকুমের গোলাম।”
“এরপর আমার সিনিয়র স্যারদের ফোন করে বিষয়টি জানালাম। বললাম, আজও আমাকে ৫টার পরে থাকতে বলা হয়েছে। তখন স্যাররা আমাকে জানান, যেন আমি চলে যাই। এরপর আবার ফোন করে পিআইও আমাকে মারপিট করাসহ প্রাণনাশ এবং অভয়নগরে না ঢোকার জন্যেও হুমকি দেন। একপর্যায়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছি। এরপর আর অফিসে যায়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তা ছুটি নিয়েছি এবং মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ দিয়ে সহায়তা চেয়েছি,” বলেন তিনি।
এই নারী কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, “ডিপার্টমেন্ট আমাকে সেফ করার জন্য বদলি করছে। তবে, আমি এর বিচার চাই। আমাকে এ বিষয়ে কথা না বলতে ও ফোন বন্ধ রাখতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। আমি চাপ উপেক্ষা করে ফোন খোলা রেখেছি। দুঃখ হয়, মেয়ের নিরাপত্তা চেয়ে আমার মা-বাবা থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তা নেয়নি।”
তিনি বলেন, “খোঁজ নিয়ে জেনেছি এর আগের স্টেশনে ইউএনও স্যারের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ছিল। আর পিআইওতো তার আগের স্টেশনে ইউএনও'র মাথা ফাটিয়েছিলেন। তার দুই বছর বেতনও বন্ধ ছিল।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিআইও শরিফ মোহাম্মদ রুবেল বলেন, “আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আমি কোনও কুপ্রস্তাব দিইনি। ওনাকে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করেছেন ইউএনও স্যার। কাজ বুঝে নিতে চাইলে বুঝিয়ে দিতেন না। অফিস ফাঁকি দিতেন। আমি তাকে বোন বলে সম্বোধন করতাম। কোনও ধরনের বাজে কথা বলিনি। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন। এ কথা শোনার পর আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী-সন্তান আছে। উনি এভাবে হেয় না করলেও পারতেন।”
ইউএনও নাজমুল হুসেইন খান বলেন, “তিনি কর্মস্থলে যোগদানের পর থেকেই অফিসে সময় দিতেন না। সর্বশেষ তাকে ৪০ দিনের কর্মসৃজনের কাজে ট্যাগ অফিসার নির্ধারণ করা হয়। এতে তিনি ফাঁকি দিতে পারছিলেন না। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী ঘর দেওয়ার প্রকল্পের একটি চিঠি দেওয়ার শেষ দিন ছিল ২৩ ডিসেম্বর। ২২ ডিসেম্বর পিআইও তাকে ফোন করেছিলেন। তাকে কাজটা করে দিতে সহযোগিতার অনুরোধ করেন। কিন্তু ৫টা বেজে যাওয়ায় ওই কর্মকর্তা অফিস ত্যাগ করেন। এ নিয়ে তাদের কথা কাটাকাটি হয়েছে। এ সময় উভয়ে কিছু আপত্তিকর কথা বলেছে। কিন্তু সে অডিও এডিট করে অপপ্রচার শুরু করেছে। কোনও প্রমাণ ছাড়াই আমাকে জড়িয়েও আপত্তিকর অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আমার রুমে সিসি ক্যামেরা দেওয়া আছে। আমিসহ অফিসে আগত সকলকে দেখা যায় ও সবকিছু রেকর্ড করা হয়।”
ইউএনও জানান, এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠিয়েছেন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, “অভিযোগটি শুনেছি। তদন্ত না করে কিছু বলা যাবে না। তবে, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”