মনোয়ার হোসেন রতন।।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ ভারতের বিভাজন দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। স্বাধীনতার সোনালি আলোয় ছোঁয়া পেলেও, এই বিভাজনের ছায়া এখনও উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভূদৃশ্যে গভীর অস্থিরতার ঢেউ তুলছে। ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হলেও, বিভাজনের প্রভাব এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সময়ের প্রবাহে বিভিন্ন অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের আগুন জ্বলতে শুরু করে।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘ ছায়া আজও ভারতের রাজনৈতিক জটিলতার অন্যতম মূলে অবস্থান করছে। ইতিহাস বিশ্লেষক ফেলিঙ্গারসহ অনেকেই মনে করেন, ভারত একক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে এবং ভবিষ্যতে এটি একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র বা ফেডারেশনে বিভক্ত হতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে বর্তমান পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা অনুসন্ধান করবো।
ঐতিহাসিক পটভূমি: বিভাজনের গভীর প্রেক্ষাপট
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত ছিল বহুজাতি, বহুভাষী ও বহুধর্মীয় এক বিশাল ভূখণ্ড, যেখানে নানা জাতি ও সংস্কৃতির মিলনস্থল গড়ে উঠেছিল। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের কুখ্যাত Divide and Rule নীতির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে তীব্রতর করে স্বাধীনতার আগেই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
১৯৪৭ সালের বিভাজন কেবল ভূখণ্ডের বিচ্ছিন্নতা ছিল না; এটি ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার এক বিধ্বংসী অধ্যায়। পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তানের সৃষ্টি এবং পরবর্তীতে পূর্বের স্বাধীনতা অর্জনের পর, ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন ও বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবি প্রবল হতে থাকে।
(সূত্র: Raghavan, 2010)
ফেলিঙ্গারের পূর্বাভাস: বিভক্ত ভারতের সম্ভাব্য রূপরেখা
বিশ্লেষক ফেলিঙ্গার ও অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারতের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য তার সংহতির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ভারতের ভবিষ্যৎ মানচিত্রে দেখা যেতে পারে:
অঞ্চল | সম্ভাব্য রাষ্ট্র/ফেডারেশন | বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|
উত্তর ভারত | পূর্ণ খালিস্তান | পাঞ্জাব ও সংলগ্ন অঞ্চলে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের দাবি |
পশ্চিম ভারত | মারাঠা রাষ্ট্র | মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে মারাঠা সংস্কৃতি ও স্বায়ত্তশাসনের চেতনা |
দক্ষিণ ভারত | দ্রাবিড় ফেডারেশন | কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরল ও আন্ধ্রপ্রদেশের সম্মিলিত ফেডারেশন |
পূর্ব ভারত | স্বাধীন বেঙ্গল | পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কিছু অংশকে ঘিরে সম্ভাব্য রূপ |
উত্তর-পূর্ব ভারত | স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল | জাতিগত ভিত্তিতে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর দাবি |
(সূত্র: The Diplomat, 2020)
ভারতের ঐতিহ্যবাহী বহুত্ববাদ ও ঐক্যের সংকট
ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি তার বহুত্ববাদ, কিন্তু একই সঙ্গে সেটিই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সংবিধানিক ফেডারেল কাঠামোর মাধ্যমে ঐক্য রক্ষার প্রচেষ্টা থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির উত্থান এই ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
খালিস্তান কিংবা দ্রাবিড় ফেডারেশনের মতো আন্দোলন শুধুমাত্র রাজনৈতিক দাবি নয়; এগুলো সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় আবেগের গভীর বহিঃপ্রকাশ।
(সূত্র: BBC News, 2023)
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: ঔপনিবেশিক ছায়ার দীর্ঘ প্রতিফলন
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংঘাত ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘস্থায়ী ছায়া হিসেবে ধরা পড়ে। ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক স্বার্থে আঞ্চলিক বিভাজনের বীজ বপন করেছিল। আজও পশ্চিমা শক্তিগুলো এই বিভাজন ও অস্থিরতার মাঝে নিজেদের কৌশলগত লাভ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
(সূত্র: Foreign Affairs, 2022)
ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা বনাম খণ্ডনের বাস্তবতা
ভারতের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তার অন্যতম গর্ব, তবে একই সঙ্গে এটি একটি জটিল ঐক্যের পরীক্ষা। ফেলিঙ্গারের মতানুসারে, যদিও ভারতের একক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, বাস্তবতা বলছে – তা ভবিষ্যতে বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র বা ফেডারেশনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এই বিভাজন রোধের চাবিকাঠি হলো — সাংস্কৃতিক সহনশীলতা, অর্থনৈতিক সাম্য এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। আগামী ভারত একক থাকবে, না খণ্ডিত — সেই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে।
তথ্যসূত্র
১. Raghavan, S. (2010). 1947: Partition in Colour. HarperCollins.
২. The Diplomat. (2020). The Rise of Indian Separatism: Why It Matters.
৩. BBC News. (2023). India’s Separatist Movements.
৪. Foreign Affairs. (2022). India Divided.
৫. The Statesman. (2023). The Long Shadow of 1947.
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com