মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মরেকর্ড যে 'মুক্তিযুদ্ধের মাঠ' নামক মৌজায় ‘রক্তাক্ত দাগ নম্বর ১৯৭১’-তে লিপিবদ্ধ আছে, তা আমরা ভুলে গেলেও ইতিহাস ভুলে না। এক কোটি উদ্বাস্তু, ত্রিশ লক্ষ প্রাণ, দুই লক্ষ সম্ভ্রম, এবং অসংখ্য গোপন কান্নার বিনিময়ে ‘বাংলাদেশ’ নামক জমিটি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের নামে ওয়ারীশ সনদপূর্বক প্রাপ্ত ছিল। কিন্তু আজ ৫৪ বছর পর সেই রাষ্ট্রীয় খতিয়ান খুললে দেখা যায়—এই জমি এখন দখলদার রাজনীতিবিদ, লুটেরা আমলা, দলীয় ক্যাডার ও দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের ‘মিউটেশন’-করা সম্পত্তি হয়ে গেছে।
এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যেন এক সদাবিহীন রেকর্ড রুম, যেখানে ‘স্বপ্ন’ নামে কোনো দলিল পাওয়া যায় না। ১৯৭২ সালের সংবিধান ছিল মূল পর্চা, কিন্তু আজ তা শতবার খারিজ ও পুনর্লিখন করে ক্ষমতালোভীদের মতো করে বদলে ফেলা হয়েছে। গণতন্ত্রের জায়গায় বসানো হয়েছে ‘শাসনতন্ত্রের রেজিস্টার্ড দলিল’—নির্বাচনবিহীন ক্ষমতা রক্ষার খসড়া চুক্তি।
প্রথম খতিয়ান (আর.এস.) অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সেই মূল খতিয়ান ছিঁড়ে ফেলা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় বি.এস. (বুনিয়াদি স্বার্থে) দখল এবং দেউলিয়ার খেলা। সামরিক স্বৈরশাসকরা নিজেদের নামে ‘পিএস (পলিটিক্যাল স্লিপ)’ কেটে ‘সার্টিফিকেট কেসে’ রাষ্ট্রের মালিকানা দাবি করে বসেন।
এরশাদের আমলে দেখা যায় এলএ খতিয়ান—Land Acquisition-এর নামে লুটপাট আর ভূখণ্ডের বেহাল দশা। মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার তখন ‘নন-কো-রেকর্ডেড’ জমির মতো দখলযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।
বিএনপি-আওয়ামী লীগের পালাক্রম শাসন ‘পজিশন কেস’-এর দাগে দাগে বিভক্ত। তারা কেউই জনগণের মূল দলিল বা মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করেনি, বরং দলীয় স্বার্থে জমাভাগ করে নিজেদের অংশ নির্ধারণ করেছে।
২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত সরকার ‘অস্থায়ী দখল সনদ’ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করেছিল, যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলা হলেও, মূল অপরাধীরা ছিল ‘গোপন নন-জুডিশিয়াল মিউটেশনে’ রক্ষিত।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের খতিয়ান দেখলে মনে হয়—বাংলাদেশ একটি ভোটারবিহীন জমি, যেখানে ভোটার আছে কিন্তু ভোট নেই, মত আছে কিন্তু প্রকাশ নেই, জনগণ আছে কিন্তু সেলফ অ্যাকুইজিশন আইন অনুযায়ী তার কোনো অধিকার নেই।
রাষ্ট্র নামক জমিটি আজ একটি দলীয় হোল্ডিং নম্বরের খতিয়ান—যেখানে বিরোধী দলের জন্য বরাদ্দ নেই। কেউ সমালোচনা করলে তাকে ‘পলিটিক্যাল দখল মামলা’য় অভিযুক্ত করে ওয়ারীশহীন ঘোষণা করা হয়।
এদেশে আজ উন্নয়ন নামক যেসব রেকর্ডেড মেগা প্রজেক্ট চলছে, তার অধিকাংশই ‘লিজ হোল্ড বাট পরিবর্তনযোগ্য খতিয়ান’—অর্থাৎ জনগণের দুঃখ ঢেকে রাখা এক ফাঁপা কাগুজে উন্নয়ন। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে 'খারিজ অর্ডার ছাড়াই'—এর বিরুদ্ধে নেই কোনো ডেপুটি কমিশনারের জবাবদিহিতা।
মানবাধিকার, সংবাদমাধ্যম, মতপ্রকাশ, এসব আজ 'দাগ ও দলিলবিহীন জমি'—যে জমির উপর দাঁড়িয়ে কথা বললেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘নোটিশ ইস্যু’ হয়।
একটি সন্তান হারানো মায়ের আর্তনাদ আজ রাষ্ট্রের রেকর্ড রুমে মিসিং ফাইল, আর একদিকে হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লুট হয়ে যায় পলিটিক্যাল ওয়ারীশ সনদধারী মহাজনের নামে।
এদেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থা যেন ‘অর্পিত সম্পত্তির’ মালিকানা দাবিকারী দলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ দখলক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। যেখানে জনগণ নামক প্রকৃত মালিকের কোনো স্বীকৃতি নেই, নেই কোনো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে তাদের স্বাক্ষর।
নতুন প্রজন্মকে আজ শেখানো হচ্ছে—রাজনীতি মানেই জমি লিখে দেওয়ার দলীয় ফর্ম পূরণ। তাদের চোখ বেঁধে তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে’ বিশ্বাসঘাতকতার আদর্শ।
এদেশের প্রত্যেকটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ডেও রয়েছে দলীয় ক্ষমতার মিউটেশনকৃত ক্যাডার গোষ্ঠী। যারা প্রশাসনের সহযোগিতায় রাজনীতি নামক জমিতে জাল দলিল তৈরি করে জনগণকে উচ্ছেদ করে দিচ্ছে।
এই প্রজন্মের জন্য একটি নতুন দলিল তৈরি করা দরকার—যেখানে সত্য হবে রেজিস্ট্রার, ন্যায় হবে দলিল লেখক, আর জনগণ হবে মালিক। চাই গণতন্ত্রের পুন:মিউটেশন, নির্বাচন কমিশনের প্রকৃত ভূমিকা, আদালতের নিরপেক্ষতা, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের “অরিজিনাল পর্চা” ফিরিয়ে দেওয়া।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির খতিয়ান যতদিন পর্যন্ত সত্যিকারের জনগণের নামে রেকর্ডেড না হবে, ততদিন এই নির্দয় ইতিহাসের খতিয়ান একেকটি নোটিশ, একেকটি ওয়ারেন্ট, একেকটি প্রহসন হিসেবে উন্মোচিত হতে থাকবে। আর প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখা থাকবে—
“এ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ হলেও, দলীয় দখলদারদের নামে মিউটেশন সম্পন্ন হয়েছে।”
তথ্যসূত্র:
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com