মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশ একটি আলোচিত এবং কখনো কখনো বিতর্কিত ইতিহাসের দেশ। এ দেশের ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে, যা রাজনৈতিক সুবিধা ও মতাদর্শিক প্রভাবের কারণে বিকৃত বা উপেক্ষিত হয়েছে। কিন্তু সত্যকে লুকিয়ে রাখা যায় না। বিকৃত ইতিহাস জাতির ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তাই আসুন—আমরা ইতিহাসের সত্যকে মেনে নিই, সত্যকে সত্য বলি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: স্বাধীনতার স্থপতি
বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, আপসহীন সংগ্রাম এবং গণমানুষের অধিকার আদায়ের অঙ্গীকার—সব মিলিয়ে তাঁকে স্বাধীনতার স্থপতির মর্যাদা দিয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তাঁর দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতির দিকনির্দেশনা দেয়। এ ভাষণ ২০১৭ সালে UNESCO’র “Memory of the World Register”-এ অন্তর্ভুক্ত হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবেও এ ভাষণের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, যা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক ভিত্তি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এ গণরায়কে উপেক্ষা করে বর্বর দমনপীড়নের পথ বেছে নেয়, যার পরিণতিতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
স্বাধীনতার ঘোষণা: অমোঘ প্রয়োজনের প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করে। ঠিক এ সময়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে এ ঘোষণাটি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে পাঠ করেন, যা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা করে।
জাতীয় চার নেতা: মুজিবনগর সরকারের রূপকার
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে বন্দী থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেন জাতীয় চার নেতা—তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় 'মুজিবনগর সরকার' গঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অসাধারণ দূরদর্শিতায় নেতৃত্ব দেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধকে সাংবিধানিক ও ন্যায্য যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
নিউক্লিয়াস: গোপন প্রস্তুতির ছায়াসংগঠন
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠিত নিউক্লিয়াস ছিল একটি গোপন সংগঠন। সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ এ সংগঠনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিলেন।
এ সংগঠনই গোপনে ‘স্বাধীন বাংলা’ মানচিত্র, পতাকা, জাতীয় সংগীত তৈরি করে। ছয় দফা, এগারো দফার মতো মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি এবং গণআন্দোলনের মূল পরিকল্পনা এই সংগঠনের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন হয়।
ছাত্র আন্দোলন ও প্রতিরোধের অগ্রভাগ
১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ সালের ছাত্র আন্দোলনেই স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়। শহীদ আসাদ, মতিউর, রেজওয়ানসহ অসংখ্য ছাত্রনেতা জীবন দেন। ছাত্রসমাজই দেশব্যাপী প্রতিরোধ কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনে নেতৃত্ব দেয়। অনেকেই সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন।
সেক্টর ও বিশেষ বাহিনী: মুক্তিযুদ্ধের সামরিক রূপরেখা
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১১টি সেক্টরে দেশকে ভাগ করা হয়। নেতৃত্ব দেন দেশপ্রেমিক সামরিক কর্মকর্তা ও বীর সেনানীরা। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী। নিচে ১১ সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারদের নাম:
১. মেজর জিয়াউর রহমান – সেক্টর ১
২. মেজর খালেদ মোশাররফ – সেক্টর ২
৩. মেজর এ.এন.এম নুরুজ্জামান – সেক্টর ৩
৪. মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি.আর. দত্ত) – সেক্টর ৪
৫. মেজর মীর শওকত আলী – সেক্টর ৫
৬. মেজর রফিকুল ইসলাম – সেক্টর ৬
৭. মেজর কাদের সিদ্দিকী – সেক্টর ৭
৮. মেজর আবু ওসমান চৌধুরী – সেক্টর ৮
৯. মেজর এম এ মঞ্জুর – সেক্টর ৯
১০. মেজর এস এম শফিউল্লাহ – সেক্টর ১০
১১. লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের (পরবর্তীতে) – সেক্টর ১১
তিনটি বিশেষ বাহিনী গঠিত হয়—
মুজিব বাহিনী (BLF)
গেরিলা ফোর্স
বিএসএফ ট্রেনিংপ্রাপ্ত বাহিনী
এছাড়াও কাদেরিয়া বাহিনী, গণবাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, মেলাঘর ফোর্স, সাদার্ন কমান্ডসহ অনেক স্বতঃস্ফূর্ত বাহিনী গঠিত হয়।
জনতার যুদ্ধ: সাধারণ মানুষের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধে এক বিশাল অংশগ্রহণ ছিল সাধারণ মানুষের। কৃষক, শ্রমিক, নারী, শিশু, শিক্ষক, চিকিৎসক, পেশাজীবী, কবি, সাংবাদিক—সবার সম্মিলিত চেষ্টায় গঠিত হয় প্রতিরোধের শক্ত ভিত্তি।
নারীরা শুধু সহানুভূতির প্রতীক ছিলেন না—তাঁরা বার্তাবাহক, সেবিকা, রান্নার দায়িত্বপ্রাপ্ত ও সরাসরি গেরিলা যোদ্ধা হিসেবেও ভূমিকা রাখেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় এই স্বাধীনতা।
আন্তর্জাতিক প্রচার ও সংস্কৃতি: মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিকতা
মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতাসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে।
বিশ্বখ্যাত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর 'Concert for Bangladesh' আয়োজন করে বিশ্বকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেন।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান তাঁদের লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরেন।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল: খেলাধুলার মাধ্যমে সংগ্রাম
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে বিভিন্ন ম্যাচ খেলে অর্থ সংগ্রহ করে এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করে। এটি ছিল ক্রীড়া ও সংস্কৃতির এক অনন্য মিলন।
বিকৃত ইতিহাস বনাম বাস্তবতা
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনীতিতে অনেক নেতার অবদান বিতর্কিত ও মুছে ফেলা হয়েছে। কিছু বীর যোদ্ধা হীন রাজনীতির শিকার হয়ে আড়ালে চলে গেছেন।
তবে ইতিহাস নিজেই ধীরে ধীরে সত্যকে পুনঃউদ্ধার করে। নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব ইতিহাসের প্রতিটি স্তরকে নিরপেক্ষভাবে জানানো—কারণ ইতিহাস কোনো দলের নয়, এটি একটি জাতির প্রাণস্পন্দন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো একক ব্যক্তির কীর্তি নয়—এটি একটি জাতির সম্মিলিত জাগরণ। তাই আমাদের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে সত্য বলে মেনে নেওয়া।