উত্তরাঞ্চলের উত্থান ও কুমিল্লা বিমান বন্দর

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষত রংপুর বিভাগ, বহুদিন ধরেই অবহেলিত এক অধ্যায় ছিল কেন্দ্রীয় উন্নয়ন ও যোগাযোগ পরিকল্পনায়। অথচ এ অঞ্চলেই দাঁড়িয়ে আছে একটি সময়ের শ্রেষ্ঠ কীর্তি— লালমনিরহাট বিমানবন্দর, যা কেবল একটি পরিত্যক্ত অবকাঠামো নয়, বরং ইতিহাস, কৌশলগত অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার এক যুগান্তকারী উপস্থাপন।
ইতিহাসের গর্ভে লুকিয়ে থাকা এক গৌরবগাথা
লালমনিরহাট বিমানবন্দর নির্মিত হয় ১৯৩১ সালে, ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্সের প্রয়োজনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি ছিল ভারত-বার্মা ফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক সাপোর্ট সেন্টার। পাকিস্তান আমলেও এটি বেসামরিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বিমানবন্দর হয়ে ওঠে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কৌশলগত ঘাঁটি। ভারতের সীমান্তবর্তী অবস্থান এর কার্যকারিতা বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
পুনর্জাগরণের প্রত্যাশা
স্বাধীনতার পর নানা কারণে এটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তবে রংপুর ও লালমনিরহাটের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও পর্যটনের প্রসার, এবং বিমান চলাচলের আধুনিক চাহিদার প্রেক্ষাপটে এটি আবারও আলোচনায় এসেছে।
২০১৭ সালে একটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইট পরিচালিত হয়। বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ফ্লাইট সফলভাবে অবতরণ করে। এটি দেখিয়ে দেয়—সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নেওয়ার পথ তৈরি রয়েছে।
কৌশলগত অবস্থান ও নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত এ বিমানবন্দর আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ, জরুরি অবতরণ ও সীমান্ত সুরক্ষার জন্য কৌশলগত সহায়ক হতে পারে। পাশাপাশি, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সংযোগে এটি এক অনন্য কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে।
উচ্চশিক্ষা ও প্রযুক্তি—লালমনিরহাটে নতুন অধ্যায়ের সূচনা
লালমনিরহাট বিমানবন্দর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি (BSMRAAU)—দেশের প্রথম অ্যাভিয়েশন ও অ্যারোস্পেস-ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি শুধু উত্তরাঞ্চলের নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের উচ্চপ্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নের এক মাইলফলক।
বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে উঠতে পারে।
পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলোর বর্তমান চিত্র ও সরকারের উদ্যোগ
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৮টি বিমানবন্দর রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন সময় ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে অথবা খুব সীমিত ব্যবহারে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
লালমনিরহাট বিমানবন্দর
বগুড়া বিমানবন্দর
যশোর বিমানবন্দর (আংশিক সক্রিয়)
রাজশাহী পুরাতন বিমানবন্দর
ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর
কুমিল্লা বিমানবন্দর
তেজগাঁও বিমানবন্দর (সামরিক ব্যবহারে সীমাবদ্ধ)
পাবনা বিমানবন্দর (রূপপুর প্রকল্পঘেঁষা)
সরকারের উদ্যোগ
বর্তমান সরকার ২০১০-এর দশকের পর থেকে পরিত্যক্ত ও সীমিত ব্যবহৃত বিমানবন্দরগুলোকে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির অংশ হিসেবে চালু করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এর আওতায়:
লালমনিরহাট বিমানবন্দরকে প্রশিক্ষণ ও কার্গো পরিবহনের জন্য ব্যবহার উপযোগী করা হচ্ছে।
বগুড়া বিমানবন্দর পুনরায় সামরিক ও জরুরি ব্যবহারে চালুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর পুনরুদ্ধারে জেলা প্রশাসন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB) যৌথভাবে কাজ করছে।
কুমিল্লা ও যশোর বিমানবন্দরকে কার্গো ও ডমেস্টিক রুটে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে।
অভ্যন্তরীণ পর্যটন ও জরুরি ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক বিমানবন্দর ব্যবহারের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন।
সম্ভাবনার দিগন্ত—রংপুর বিভাগের জন্য যা আনতে পারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
কৃষিপণ্য পরিবহন: উত্তরাঞ্চলের আলু, লিচু, আম ও সবজি দ্রুত রাজধানী বা বিদেশে পাঠানো সম্ভব হবে।
জরুরি স্বাস্থ্যসেবা: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিবহন, রোগী স্থানান্তর বা ওষুধ সরবরাহে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা মিলবে।
পর্যটন বিকাশ: কান্তজীর মন্দির, রামসাগর, তিস্তা ব্যারাজসহ অঞ্চলজুড়ে পর্যটনে উচ্ছ্বাস আসবে।
চাকরি ও শিল্পায়ন: বিমানবন্দর কেন্দ্রিক ইকোনমিক জোন গড়ে উঠতে পারে, নতুন শিল্প, হোটেল, কোল্ড স্টোরেজ ও পরিবহন খাত বিকশিত হতে পারে।
সম্ভাবনার পাখনায় ভর করে উড়ুক বাংলাদেশ
লালমনিরহাট বিমানবন্দর এখন কেবল ইতিহাসের অংশ নয়, এটি হতে পারে উত্তরাঞ্চলের ঘুমন্ত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার এক দৃঢ় মাধ্যম। সরকার, বেসরকারি খাত এবং সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে এ বিমূর্ত স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে।
সদিচ্ছা, টেকসই নীতিমালা এবং প্রযুক্তিনির্ভর পরিকল্পনা থাকলে—লালমনিরহাট থেকে আকাশে উঠবে সম্ভাবনার ডানা, আর তা ছুঁয়ে যাবে এক নতুন বাংলাদেশ।
তথ্যসূত্র:
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB) প্রতিবেদন, ২০১৭
দৈনিক ইত্তেফাক ও বাংলাদেশ প্রতিদিন (২০১৮, ২০২০)
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা, জাতীয় আর্কাইভ
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিমানবন্দর পুনঃচালুর সংক্রান্ত প্রতিবেদনসমূহ (২০১৯–২০২৪)।
inside post
আরো পড়ুন