একজন দয়াল খালেকের বিদায়

– মনোয়ার হোসেন রতন।।

একজন মানুষের শারীরিক মৃত্যু যখন ঘটে, তখন সেই শূন্যতা শুধুই তার অস্তিত্বের নয়—তা ছড়িয়ে পড়ে তাঁর কাজ, আদর্শ, অবদান ও ভালোবাসার মাঝে। এমনই এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, যখন কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার বাতাবাড়িয়া গ্রামের কৃতি সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক, আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন চিরপ্রস্থানের পথে। যিনি স্নেহময় শ্রদ্ধার“দয়াল খালেক” নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি ছিলেন কেবল একজন ব্যক্তি নন—তিনি ছিলেন এক প্রেরণার উৎস, এক জীবন্ত ইতিহাস।
তাঁর মৃত্যু আমাদের মনে এক গভীর শোকের রেখাপাত করেছে। মনে হচ্ছে, যেন এক যুগের অবসান ঘটলো। তাঁর রেখে যাওয়া জীবনদর্শন, কর্মকাণ্ড ও মূল্যবোধ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—একজন মানুষের প্রকৃত মূল্য বোঝা যায় তাঁর চলে যাওয়ার পর, ঠিক তখনই যখন তাঁর অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি অনুভব করি।
মৃত্যুতে নয়, জীবনে ছিলেন মহিমান্বিত
ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই কন্যা এবং অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন।
আমার জন্য এই শোক কেবল সামাজিক নয়, ব্যক্তিগতও। তিনি আমার ফুফাতো ভাই ছিলেন। ছোটবেলা থেকে তাঁর স্নেহময় ছায়া আমার ওপর ছিল। শৈশবের বহু স্মৃতি আজ চোখে ভাসছে—যেখানে তিনি আমাকে আদর করতেন, শিখাতেন কিভাবে মানুষ হতে হয়, কিভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়।
তাঁর চলে যাওয়া যেন আমার আত্মিক বন্ধনের এক বড় খণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো। তিনি শুধু কাছের একজন মানুষ নন, ছিলেন অনুপ্রেরণার এক চিরন্তন আলোকবর্তিকা।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান: অস্ত্রের চেয়েও বড় ছিল মনোবল
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তখনকার তরুণ আব্দুল খালেক কোনো দ্বিধা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ মাতৃকার জন্য। হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র, বুকে ধারণ করেছিলেন অদম্য সাহস।
তাঁর অবদান কেবল একটি যুদ্ধ জেতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না—তাঁর সংগ্রাম ছিল একটি জাতির মর্যাদা রক্ষার জন্য, মানবতার মুক্তির জন্য। মাঠের যুদ্ধে তিনি যেমন সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছেন, তেমনি পরবর্তী জীবনেও সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাঁর প্রতিটি কাজে প্রতিফলিত হয়েছে।
“বীর মুক্তিযোদ্ধা” খেতাব তাঁর জন্য কেবল একটি উপাধি নয়, বরং তাঁর জীবনের সত্যিকার পরিচয়। দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল নিখাদ, নিঃস্বার্থ ও গভীর। এমন একজন মানুষ ছিলেন তিনি, যিনি আজীবন স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন—কথায়, কাজে, এবং বিশ্বাসে।
একজন ব্যতিক্রমী জনপ্রতিনিধি
জনপ্রতিনিধিত্ব মানে কি কেবল ক্ষমতার আসন দখল করা? না। জনপ্রতিনিধিত্ব মানে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা। এই উপলব্ধি যারা হৃদয়ে ধারণ করেন, দয়াল খালেক ছিলেন তাঁদেরই একজন।
লাকসাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি যে সময়টুকু দায়িত্বে ছিলেন, তা শুধু প্রশাসনিক সফলতার ইতিহাস নয়—তা একটি নেতৃত্বের আদর্শ হয়ে উঠেছে।
তিনি রাজনীতিকে দেখেছিলেন জনসেবা ও জনকল্যাণের একটি সুযোগ হিসেবে। কখনোই রাজনীতিকে ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে ব্যবহার করেননি। তাঁর সময়ে লাকসামে বাস্তবায়ন হয়েছে বহু উন্নয়ন প্রকল্প—রাস্তা, সেতু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র, কৃষি সহায়তা কর্মসূচি—সব ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর কার্যকর দৃষ্টি ও পরিকল্পনা।
তিনি বলতেন,
“উন্নয়ন মানে কেবল প্রকল্প নয়, মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারা।”
এই দর্শন থেকেই তিনি প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতেন। জনগণের দুঃখ-কষ্ট তাঁর নিজের মতো করেই গ্রহণ করতেন। মানুষ যখন তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য আসতো, তখন তিনি একজন জনপ্রতিনিধি নন, একজন আত্মীয়ের মতো মনোযোগ দিতেন। এমন জনপ্রতিনিধি আজকাল বিরল।
ব্যক্তিত্বে ছিলেন কোমল, হৃদয়ে ছিলেন সবার
দয়াল খালেক ছিলেন দৃঢ়চেতা, কিন্তু হৃদয়ে অত্যন্ত কোমল। তাঁর আচরণে কখনো ঔদ্ধত্য ছিল না। সবার সাথে মিশতেন সহজাত আন্তরিকতায়। ছোট-বড়, ধনী-গরিব—সবাই তাঁর কাছে সমান গুরুত্ব পেত।
গ্রামের মানুষরা আজও বলেন,
“খালেক ভাইয়ের মতো মানুষ আর পামু না।”
তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি সকালে উঠে হাঁটতে বেরিয়ে স্থানীয়দের খোঁজখবর নিতেন, গ্রামের কোনো সমস্যা হলে আগে নিজে গিয়ে দেখতেন। পারিবারিক জীবনেও ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী ও পিতা। তাঁর সন্তানদের মধ্যে দেশপ্রেম, সততা ও নীতিনিষ্ঠতা সঞ্চার করেছিলেন, যা আজও তাঁদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়।
চলে যাওয়া মানে হারিয়ে যাওয়া নয়
আজ দয়াল খালেক আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে নেই ঠিকই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ, কর্ম ও বিশ্বাস আমাদের জীবনে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে মানুষ হতে হয়, কিভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে নেতৃত্ব দিতে হয় হৃদয় দিয়ে।
তিনি ইতিহাসে একজন “বীর মুক্তিযোদ্ধা” হিসেবে চিহ্নিত থাকবেন, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে তিনি থাকবেন একজন আপনজন, একজন আলোর দিশারী হিসেবে।
শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি
আজ আমরা যখন তাঁর বিদায়ে চোখে জল ফেলছি, তখন মনে রাখতে হবে—এই কান্না শুধু শোকের নয়, কৃতজ্ঞতারও। আমরা কৃতজ্ঞ, কারণ তাঁর মতো একজন মানুষকে আমরা আমাদের জীবনে পেয়েছিলাম। তাঁর কাছ থেকে আমরা শিখেছি, আদর্শ কীভাবে জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।
দয়াল খালেক—আপনার জীবন ছিল আমাদের জন্য একটি পাঠশালা, একটি চেতনার আলো। আপনি চলে গেছেন, কিন্তু আপনার শিক্ষা, নীতি আর ভালোবাসা চিরকাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিদায়, বীর।
আপনি আমাদের হৃদয়ে অমর।