প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ৫:২৪ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ অক্টোবর ২৪, ২০২০, ৫:৫৭ অপরাহ্ণ
একটি মেয়ে ধর্ষণ হলো। ঘরের ভেতর ঢুকে তাকে ধর্ষণ করা হলো। গণধর্ষণ। এরপর বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া কী হয়? এক কথায় বলতে গেলে- মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এই জাতিটাই শংকর। নানা জাতের মিশ্রণ। তাই মতেরও শেষ নেই। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে ছাপ্পান্ন কোটি মতামত। ছাপ্পান্ন কোটি মতাদর্শ। মত আর মতাদর্শের মারামারি এবং যুদ্ধে কোন আন্দোলনই সফল হয় না। কোনদিন তারা এক হতে পারে না।
হবে কিভাবে? বামপন্থী বলুন, আর ডানপন্থী বলুন- সবাই থাকে নিজেদের পাল্লা ভারী করতে। অনেকটা এমন- একদল বলে 'আমি ভালো, আমার আদর্শ অনুসরণ করলে ধর্ষণ কমবে' আরেকদল বলে 'ওরা বাজে লোক। আমাদের আদর্শ অনুসরণ করলে স্থায়ী সমাধান আসবে'। মোটকথা, দুই পক্ষই নিজেদের মতাদর্শের ফায়দা লুটতে চায় নিজ নিজ মতাদর্শের ব্যানারে থেকে, ব্র্যান্ডিং করে। এছাড়াও লিপ্ত হয় বাকযুদ্ধে। কাউন্টার আর এনকাউন্টারের এই যুদ্ধ চলতে চলতে ঘটনার মূল বিষয়বস্তু হারায় তার অস্তিত্ব। অথচ দুই পক্ষই এক থাকতে পারতো একটি জায়গায়- চিরস্থায়ী সমাধানের প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে 'আইন সংশোধন, বিচার কার্যকর এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ'। দুই পক্ষই এই বিষয়কে ঘিরে একযোগে আওয়াজ তুলতে পারতো, পারতো ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়া ঠেকাতে, হালকা না করতে।
কেননা, মতাদর্শ যা ই হোক না কেন, সেখান থেকে মানুষ একটা বিষয়ই আশা করে- ন্যায়। কাজেই, ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার জন্য কঠোর অবস্থানে যাওয়াটাই উচিত ছিলো বামপন্থী ডানপন্থী দুই পক্ষেরই। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে এবং বেশকিছু ভন্ডদের জন্য তারা একযোগে আন্দোলন করতে সমর্থ হয় না। এটা আদর্শগত ভিন্নতার ফলেই। কিন্তু সবার জানা উচিত আদর্শ যা ই হোক, সেটা হতে হবে ন্যায়ের। আর ন্যায়ের পক্ষে কোন বিভক্তি চলবে না। মারামারি চলবে না। দুই পক্ষ তর্কে লিপ্ত হওয়া চলবে না। কিন্তু বাংলাদেশে দুই পাক্ষিক বিভক্তি এবং তর্কের ফলে কিছুই সফল হয় না। এটা এদেশের মানুষের জন্য অভিশাপের জায়গা বটে। এসবের ফলে ভোগবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধা হয়। তারা ব্যবসা করতে পারে এদেশে। পুঁজিবাদের ব্যবসা। আমরা বিভক্ত হয়ে তাদেরকে সেই ব্যবসার সুযোগ করে দেই। আর চলতে থাকে অত্যাচারী শাসকদের জুলুমের শাসন। তাই বোঝা দরকার, মতাদর্শ যা ই হোক, ন্যায়ের প্রশ্নে সবার এক হওয়া উচিত। আর তর্কের চেয়ে কাজ বড়। কাজ করুন। নিশ্চয়ই মানুষ উৎকৃষ্ট মতাদর্শ মেনেই চলবে। কারণ, সাধারণ মানুষ শান্তি চায়। যুদ্ধ চায় না। অন্যায় চায় না।
এটা তো গেলো মতাদর্শের ব্র্যান্ডিং করার কাহিনী। বিভক্ত হওয়ার কাহিনী। এরপর আছে 'ভিকটিম ব্লেমিং'। এই ঘৃণ্য কাজটি বাংলাদেশে চরমে পৌঁছেছে। মজলুমের ওপরই দোষ চাপানোর মত কুকর্ম যারা করেন, তাদেরকে আগে বিচারের আওতাভুক্ত করা দরকার। এই কুকুরগুলো পরোক্ষভাবে অপরাধকেই সমর্থন দেয়। তাই তারাও সমান অপরাধী। কথায় তো আছেই- "অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃনসম দহে"। অর্থাৎ, অন্যায় সমর্থনকারীরাও সমান অপরাধী। তাই 'ভিকটিম ব্লেইমিং' কেউ করলে তার পরিচয় সম্মুখে আনা প্রয়োজন। আইনী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। মজলুমের ওপর দোষ চাপানোর বিষয়টি দ্বিতীয়বার তাকে জুলুম করার সমান। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা এসব সহ্য করবেন না। তাই এসব করার আগে একটু ভাববেন।
আমাদের মাঝে আরেকটি সমস্যা আছে। ধর্ষণের জন্য নানা কারণ দর্শানো। এটা দায়ী, ওটা দায়ী- একেকজন একেকটা কারণ দর্শাতে থাকে। এক্ষেত্রে কিচ্ছু বলার নেই। ধর্ষণের পেছনে যারা একক কোন কারণ দেখান, তারা আসলে নির্বোধ। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন এরিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি কতৃক ধর্ষণের ভিন্ন কারণ থাকে। তাই একক কোন কারণ দেখানো মূর্খতা। যেখানে যেই কারণে ধর্ষণ হয়েছে সেটি খতিয়ে দেখা হোক। প্রশাসন আছেই এ কাজ করার জন্য। নাহলে তাদের ভূমিকা কী? কেন তারা বেতন নেয়? দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে লজ্জিত হওয়া উচিত প্রশাসনের।
এবার আসি আরেক দলের প্রসঙ্গে। যারা দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের নামে নানা প্রসঙ্গ তুলে আনে এবং নিজস্ব মতাদর্শের ভেতরে থেকে একের পর এক বায়াসড বিতর্ক করতে থাকে। তাদের লেখার ফলে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। একটা উদাহরণ দেই- ধরুন কেউ একজন দূর্ঘটনায় আহত হলো। তাকে প্রথমেই হাসপাতালে নিতে হবে। তার জীবন বাঁচাতে হবে। পরবর্তীতে সড়ক দুর্ঘটনার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য আন্দোলন করতে হবে। এখন আপনি যদি লোকটিকে রাস্তায় আহত ফেলে রেখেই প্ল্যাকার্ড হাতে, পোস্ট লিখে আন্দোলন শুরু করেন- "নিরাপদ সড়ক চাই" স্লোগানে, এটা অনুচিত। এটা অন্যায়। এতে লোকটার প্রাণ যাবে। আর সড়ক নিরাপদ হবে কিনা সেটারও কোন নিশ্চয়তা আপনারা শুরুতেই পাবেন না। তেমনিভাবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে, প্রথমে বিচার নিশ্চিতকরণ নিয়ে কথা বলতে হবে। সোজা কথায়- ভিকটিমের প্রতি যে অনাচার হয়েছে, অপরাধীর সেই শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। সবার সর্বপ্রথম দাবিই হতে হবে এটা। একযোগে, পুরো বাংলাদেশে। একই কথা- ধর্ষকের কঠিন সাজা দেখতে চাই।
সাজা নিশ্চিত না হওয়ার আগে অন্য কোন সমাধান খোঁজা ভন্ডামি, নিজেদের মতাদর্শেরই ব্র্যান্ডিংয়ের আওতাভুক্ত সেটি। একজন মজলুমের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচার নিশ্চিত না করে আপনারা কোন সে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের কথা তোলেন?
এক ঘটনার বিচারই আগে করে দেখান। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের প্রথম বিজয়ই- সদ্য ভিকটিম হওয়া নারীর ওপর জুলুমের বিচার নিশ্চিত করা। এটা নিশ্চিত না হওয়ার আগে, আপনারা যারা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নিয়ে পোস্ট করে মূল বিষয়বস্তুকে হালকা করেন, তারা আসলেই চরম মাপের মূর্খ। সৃষ্টিকর্তা আপনাদেরকে জ্ঞান দিক। আপনারা তো ঐসব লোক, যারা ধান চাষ না করেই ভাতের আশা করে থাকে। এখনও সময় আছে বুদ্ধি খাটিয়ে নিন। মাথায় সূক্ষ্ম চিন্তা ঢোকান। সরকার বিচার না করতে পারলে স্বয়ং শাসকের বিরুদ্ধেই আঙুল তুলুন। কারণ, নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে না পারা একটি ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দায় শাসকদেরকে নিতে হবে। স্বাধীন নাগরিকের অধিকার আছে শাসকদের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আঙুল তোলার। আন্দোলন করার।
সবশেষে বলতে চাই, ধর্ষক একটা সাইকো। পুরুষাঙ্গ কোটি কোটি পুরুষেরই আছে। সমস্যা পুরুষাঙ্গে নয়, সমস্যা হচ্ছে মস্তিষ্কে। এটা ধর্ষকের সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম। তাই তাদের বিরুদ্ধে এগ্রেসিভ ব্যবস্থা নিতে হবে। সাইকোদের বিরুদ্ধে এগ্রেসিভ না হয়ে, নারীদেরকে হীনমন্যতায় ভোগানো এবং ডিফেন্সিভ মুডে রাখার ব্যাপারটি সাইকোদেরকে ভয় পাবার শামিল। দুই চারটে মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ মরলে সমস্যা নেই, কিন্তু মা-বোনরা নিজেকে, নিজের শরীর নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগলে তা দুঃখজনক। তাদের এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার দায় পুরুষ হিসেবে আমাদের ওপরেও কিছুটা বর্তায়। আমরা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মা-বোনরা কাদেরকে ভয় পায়? কেন ভয় পায়? কেন হীনমন্যতায় ভোগে? নিজেকে প্রশ্ন করুন। আমরা সমাজ সংস্কার অবশ্যই করবো। অশ্লীলতা দূর করবো। নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবো। কিন্তু সবার আগে বিচার নিশ্চিত করা নিয়ে আন্দোলন করবো। শাসক যদি জালিম হয়, তাদের জন্য অরাজকতা সৃষ্টি হলে, তাদের বিরুদ্ধেও কথা বলবো। এটাই সবার অবস্থান হওয়া উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।