এখনই ঐক্য গঠনের সময়

রক্তের ঋণ ও গণতন্ত্রের দায়:
মনোয়ার হোসেন রতন।।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি সরকারের পতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি ছিল একটি জনরোষের বিস্ফোরণ, একটি দীর্ঘ প্রতারণা ও শোষণের বিরুদ্ধে জনতার জাগরণ। তবে স্বৈরতন্ত্রের পতনের মধ্যেও জন্ম নিতে পারে নতুন স্বৈরতন্ত্র—যদি আমরা সচেতন না হই, যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের দায়িত্বে অবিচল না থাকে। আজ, যখন রাষ্ট্রপ্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে—ঠিক তখনই ইতিহাস আমাদের ডাকছে: ঐক্য চাই, এখনই চাই।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগেও আমরা সংকটকালে ঐক্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখেছি। ১৯৫৪ সালে মতাদর্শগত বিভেদ উপেক্ষা করে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন হয়েছিল—শুধু একটি স্বৈরশাসন ঠেকাতে নয়, বরং বাঙালির আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য। আজ সেই প্রয়োজন আরও গভীর। আজকের লড়াই কেবল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, লড়াই একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য—যেখানে থাকবে না গুম-খুন, থাকবে না বাকস্বাধীনতার কণ্ঠরোধ, থাকবে না বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
দেশ আজ এক দ্বিধার মোড়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে দীর্ঘ সংগ্রামের ক্লান্তি, অন্যদিকে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। ঠিক এই সন্ধিক্ষণে প্রয়োজন একটি বাস্তববাদী, দায়িত্বশীল, এবং নৈতিক রাজনৈতিক ঐক্য। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রে এখনো সক্রিয় রয়েছে সেই পুরনো শাসকের দোসররা—যারা জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে, বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আন্দোলনের নেতৃত্বকে দুর্বল করে দিতে চায়। তারা কখনোই চায় না জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব গড়ে উঠুক।
এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রকামী সব রাজনৈতিক শক্তিকে, নাগরিক সমাজকে, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও তরুণদের এক প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াতে হবে। ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ নয়—জাতির স্বার্থই হতে হবে সর্বাগ্রে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা বহুবার দেখেছি, কীভাবে নেতৃত্বের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বা বিভাজন গণআন্দোলনকে পেছনে ঠেলে দেয়। আর আজকের দুনিয়ায় গণতন্ত্র কেবল ভোট নয়, এটি একটি মানসিকতা—যার ভিতে থাকবে ন্যায্যতা, মানবিকতা ও জবাবদিহিতা।
শুধু রাজপথ নয়, চিন্তার ময়দানেও তৈরি করতে হবে ঐক্য। দল-মতের ভিন্নতা থাকবে—তবুও জাতীয় সংকট মোকাবেলায় ঐক্যই চূড়ান্ত শর্ত। আমাদের দুর্ভাগ্য, আজ শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিংবা ভাসানীর মতো দূরদর্শী ও আত্মত্যাগী নেতার বড় অভাব। কিন্তু বিশ্বাস রাখতে হবে—দেশের মাটিতে এখনো অগণিত তরুণ, মুক্তমনা মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মী রয়েছেন, যাঁরা দেশটাকে ভালোবাসেন নিঃস্বার্থভাবে।
আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি—স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, মতপ্রকাশের অধিকার, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা। এগুলোর পুনরুদ্ধার সম্ভব শুধুমাত্র রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে। সময় এখন হাতছাড়া হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে, ঐক্যবদ্ধ  হতেই হবে। গণতন্ত্রকে নতুন ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হলে চাই এক শক্তিশালী ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক ঐক্যফ্রন্ট—যেটি কেবল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, একটি মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণের দিকেও অগ্রসর হবে। এখনই সময়, আর নয় বিলম্ব।
inside post
আরো পড়ুন