।। ডা আবু মোহাম্মদ নাঈম ।।
করোনা, কোভিড ১৯, মহামারী, অতিমারী। একই অসুখ নানা স্ট্রেইন পালটে দুনিয়াটাকে মৃত্যুপুরী বানিয়েছে। করোনা দেশে প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ, ২০২০। কিন্তু তখনো দেশে করোনা দেশে ঝাঁকিয়ে বসেনি। আগেই আমার কর্মস্থলে সে অসুখ শনাক্তের সবচে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা আরটি পি সি আর মেশিন আনা হয় ২৬ এপ্রিল ২০২০। এরপর দিন থেকেই পুরোদমে ল্যাবটি চালু হয়ে যায়।
চারদিকে তখন ত্রাহি অবস্থা। কেউ কারো খবর নেয়না। মা আক্রান্ত বলে সখীপুরের বনে রেখে চলে গেলো সন্তানেরা। এমনো সন্তান ছিলো মা বাবাকে একলা হাসপাতালে রেখে চলে যেতো। আবার সদ্যোজাত সন্তান মারা গেছে শুনে অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলেন বরুরার এক গৃহবধূ। খানিক পর মাও সন্তানের ঠিকানায় পাড়ি জমান।
আবার এমনো হয়েছে মা নিজের মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়েছেন পাশের বেডে আক্রান্ত তার ছেলের অক্সিজেন স্যাচুরেশনটা যেনো ঠিক থাকে। বলা যায় মায়া -মমতা, নিষ্ঠুরতার এক কঠিনতম পরীক্ষায় তখন সভ্যতা।
হাসপাতালগুলোতে শুধু অ্যাম্বুলেন্স আসার শব্দ, কান্না আর আহাজারিতে চারপাশ ভারী।
লাশ দাফন করার জন্য কেউ আসেনা। মসজিদ, মন্দিরে কোন ভিড় নেই। বাজার খাঁ খাঁ করছে। স্কুল কলেজ, অফিস কোথাও কারো পদচারণা নেই। ঈদ, বৈশাখসহ সব আনন্দ উদযাপন তখন নিরানন্দ। এরপর লকডাউনে পুরো দেশ। মহাসড়ক স্থবির। স্থবির যেনো গোটা সভ্যতা।
ঠিক সে সময়ে আমার দায়িত্ব পড়ে করোনা টেস্টের ল্যাবে। বাসা থেকে প্রবল আপত্তি, যেনো আমি এই দায়িত্ব পালন না করি। আত্মীয়-স্বজনরা ফোন করে বললেন- প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দাও। সবার একটাই কথা এভাবে জীবন ঝুঁকি নেয়ার মানে হয়না।
আমি চাইলেই পিছিয়ে যেতে পারতাম। আরও অনেকের মতো। কিন্তু পিছিয়ে তো যায় কাপুরুষরা। পেশাগত দায়িত্ব পালনে দেশে আর যত পেশা আছে যেখানে জীবনের ঝুঁকি আছে। জেনেছি সবাই ঝুঁকি ভাতা পান। হয়ত তাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বলেই ঘোষণা এলো প্রণোদনার। তা নিয়ে পরে কী হলো তা আর নাইবা বলি। প্রণোদনা এখনও অমাবস্যার চাঁদ।
হেপাটাইটিস ভাইরাস, এইচআইভি, কোভিডসহ এমন হাজারো মরণব্যাধি নিয়েইতো চিকিৎসকদের কাজ। কেউই সম্ভবত টাকার কথা ভেবে চিকিৎসা করেন, একথা আমি চিন্তাও করতে পারিনা। অনেকেই শুধু চিকিৎসা দিতে গিয়েও আক্রান্ত হয়েছেন এসব অসুখে।
আমি দু'বার ভাবিনি এই ল্যাবে কাজ শুরু করার আগে। আমার বসবাস নিশুতি গ্রামে। এলাকায় সবার মুখে রটে যেতে সময় লাগলো না এ খবর। আমাকে দেখলেই গ্রামের সড়কে থাকা লোকেরা ভয়ে পালাত সে সময়। যেনো এভাবে পালিয়ে অসুখ থেকে বাঁচা যাবে।
ভোর ৮টায় ঢুকতে হতো ল্যাবে। ঢুকবার আগে ওটি ড্রেস পরে নিতাম। তার উপর ফেইস শিল্ড, এন ৯৫ মাস্ক,গগলস, পিপিই, পলি শিট। এই নামগুলো লেখা যত সহজ এদের পরা ততটাই কঠিন। এসব পরে কাজ করা আরোও কঠিন। মাঝেমধ্যে রাগ লাগতো। স্রষ্টার কাছে অভিযোগ জানাতাম যে- মানুষ ভালো করে শ্বাসটাও বুঝি নিতে পারবেনা। কখন বেলা গড়িয়ে দুপুর, বিকেল হতো! নিজেও টের পেতাম না।
রমযান মাসে ইফতারের সময় এসব পরিধেয় ড্রেস খুলতাম ইফতারের আগে। অন্য সময় দুপুরের দিকে বিস্কুট,কেক, কফি এসব কোন রকমে মাস্ক খুলে খেয়েই দিন কাটাতাম। কারণ একবার ডফিং ( পোশাক খুলে ফেলা) এর পর ল্যাবে ঢুকতে হলে আবার নতুন সেট ড্রেস লাগবে। যা সরকারের জন্য অবশ্যই একটি অপব্যয়। জেনেশুনে তাই কাজটা করতাম না।
যদিও ল্যাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিলো। না হলে এত স্তরের পোষাকের জন্য ঘেমে নেয়ে একাকার হতাম।
কাজ করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে প্রায়ই বিকালের দিকে আমার দুই চোখে ঘুম চলে আসতো। শ্বাস বন্ধ করে রাখলে কিছুক্ষণ পর আবার ঘুম ভাব চলে যেতো।
ল্যাবের কাচের দেয়ালের এক পাশে ছিলো আমাদের এক্সট্র্যাকশন রুম। আরেকদিকে মাস্টারমিক্স এবং এনালাইসিস রুম। আলাদা টেলিফোনে কথা হতো একের সাথে অন্যদের। টেস্ট করার সময় প্রতিটি ধাপে খুব সতর্ক থাকতে হয়। যে ভায়ালে করে স্যাম্পল আসতো খুব সন্তর্পণে তার মুখ খুলতে হতো। এরপরের ধাপ গুলো করার পর মেশিনে দিতে হতো। মেশিনে সময় লাগতো পৌনে দুই ঘন্টার মতো।
এভাবে টানা দুই বছর কাজ করে গেছি। সকাল গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা, রাত কখনোবা বাসায় ফিরতে ভোর রাত হতো। বাসায় যত রাতেই ফিরতাম দেখতাম আম্মা বাড়ির মেইন গেইটে দাঁড়িয়ে। আম্মা, মা, জননী এক অপূর্ব সৃষ্টি স্রষ্টার। ঈশ্বর আর মা দুয়ের মাঝে সম্ভবত মা-ই তার সন্তানকে বেশি ভালোবাসেন!
প্রতিটা দিন কাটতো আমার মায়ের উৎকন্ঠায়। উৎকন্ঠা তাঁর নিজের জন্য না। আমার জন্য।
আমি ল্যাবে জয়েন করার কয়েক মাসের মধ্যেই আমার আম্মা কোভিড পজিটিভ হন। একই সাথে আব্বাও। দু'জনেই উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের রোগী। তখন জেলার প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড রোগী রাখা হয়না। শুরুতে বাসায় রেখে চিকিৎসা করলেও আব্বার অবস্থার অবনতি হলে উনাকে ঢাকা নিয়ে যেতে হয়। আম্মা কুমিল্লার আরেক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তখন।
আমার এত আত্মীয়জন। তেমন কেউ আমার পাশে এসে তখন দাঁড়ায়নি। কেউ দেখতে আসেনি। খোঁজ নেয়নি। আম্মাকে একা রেখে আমি যখন ঢাকা যাচ্ছিলাম আব্বাকে নিয়ে। তখন বুক ফেটে যাচ্ছিলো, এই ভেবে যে মা- বাবার মাঝে আমি কীনা বাবাকেই বেছে নিলাম!
গাড়িতে বসে অঝোর কান্না করছিলাম আর আল্লাহর কাছে চাইছিলাম আর একটাবার অন্তত আরেকবার যেনো বাড়িতে সবাইকে নিয়ে একসাথে খেতে বসতে পারি। আবার যেনো একসাথে হতে পারি মা -বাবার। আমার এক কাজিন আম্মাকে রোজ হাসপাতালে এসে খাবার দিয়ে যেতেন। আমি আজন্ম তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
দিন সাতেক যুদ্ধের পর বাবা-মা দুজনের সাথেই একত্রে বাড়িতে ফিরি।
আমাদের গ্রামে আব্বা -আম্মাই প্রথম শনাক্ত হয়েছেন। আমরা মোটামুটি একঘরে তখন। কেউ বাড়ির পাশে আসেনা। অথচ আশেপাশে অনেকেই কোভিড লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন। টেস্ট অব্দি করায়নি তাদের কেউ। যে আদর্শ সমাজের কথা আমরা বলি সেই সমাজ কারো দুঃখে বা বিপদে পাশে না থাকলেও সুখের সময়ে, চাঁদা নেয়ার সময়, টাকার ভাগ নেয়ার সময়ে ঠিক এসে হাজির হয়ে যায়।
আঁধার শেষে আলো আসে। কোভিড এখন আর কোন আতংকের নাম নয়। এই কোভিডে হাজার, লাখ পরিবার নিজের স্বজন হারিয়েছেন, অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন চিকিৎসা করাতে গিয়ে, অনেকে কোভিড পরবর্তী জটিলতায় ভুগেছেন, চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৮৫ জন চিকিৎসক।
মহামারীর সেসব দিনের স্মৃতি আমি কখনো ভুলব না।
লেখক:চিকিৎসক ও পরিবেশকর্মী।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com