।। ড. সফিকুল ইসলাম ।।
ঈদ বললেই আনন্দ চোখে ভাসে। মনে হিল্লোল বয়ে যায়। বয়স বাড়তে থাকলে যদিও ঈদের কিছু আনন্দ ফিকে হয়ে আসে, তবুও মনের মধ্যে একটা বাড়তি আমেজ কাজ করে। কবি কাজী নজরুলের ‘‘ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানি তাগিদ‘‘ মনের মধ্যে বাজতে থাকে। যদিও ঈদ মানেই খুশি, তবুও সেই খুশি আবার সব বয়সে সমান না। শৈশবে একরকম হলে কৈশোরে অন্যরকম, যৌবনে একরকম হলে বৃদ্ধ বয়সে আরেকরকম। কর্মজীবীর একরকম হলে বেকারের ভিন্নরকম, গরিবের একরকম হলে ধনীর অন্যরকম।
আমার ঈদের নানান স্মৃতি রয়েছে। তবে আজ আমি আপনাদের উদ্দেশে আমার কর্মস্থলের ঈদের স্মৃতিচারণ করবো। আমি সবসময় গ্রামপ্রেমী মানুষ। শৈশব ও কৈশোর যেখানে ফেলে এসেছি, সেখানে ফিরতে সবসময় মন আঁকুপাকু করে। তাই জীবন এখন পঁয়তাল্লিশ ছুঁইছুই হলেও এখনও প্রতিবার প্রতি ঈদে গ্রামে ছুটে যাই। গ্রাম ছাড়া ঈদ করা আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। তবু আমরা মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে অনেক কাজ করতে হয়। কঠিন বসদের কঠোর অনুশাসনে ছুটি মেলে না কোনো কোনো সময়। তখন ‘পড়িলে মোড়লের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে‘- প্রবাদ মনে রেখেই মেনে নিতে হয়।
এরকমই কয়েকবার কর্মস্থলেই ঈদ কাটাতে হয়েছে। একবার ঈদে ছুটি পাই নি। একা একা কর্মস্থলে ঈদ করছি। গ্রামের ঈদগাহ মিস করছি, মিস করছি বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন। মিস করছি বড় ভাই হিসেবে সবাইকে সেলামি দেওয়ার আনন্দ। এর মধ্যে সবার অনুযোগ কেন আমি গেলাম না। কবে যাবো। এমনিতেই না যেতে পারায় মন খারাপ, তার উপরে আবার একেকজন ফোন করে করে ‘‘আমাকে তারা মিস করছে‘ জানায়। তখন আমার আরও বাঁধভাঙা ঢেউ ওঠে বুকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, কিচ্ছু দেখি না। তবুও জেলা প্রশাসনের নানান অনুষ্ঠান, খাওয়া দাওয়া ইত্যাদিতে চলে যায় ঈদের দিনটি। মায়ের হাতের সেমাই খাওয়া হলো না, বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া হলো না- এরকম নানান স্মৃতি মানসপটে ভাসে। সেবার ছিল কুরবানির ঈদ। কুরবানির গরু কেনা ও এ নিয়ে নানান বাদানুবাদ আর স্মৃতিচারণ আমার মনে পড়তে থাকে। সব চাপা দিয়ে জেলা প্রশাসনের কাজে ব্যস্ত থাকি। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এসব ছোটখাটো বিষয় পাত্তা দিতে হয় না। মন শক্ত রেখে কাজ করি। ঈদের দিন, পরের দিন, ঈদ সংক্রান্ত কাজ, অনুষ্ঠানাদি ও খাওয়াদাওয়ার দাওয়াতে কেটে যায়। কিন্তু এরপরেই অফিস খোলা। ঢিমেতালে অফিস খুলে, কেউ আসে কেউ আসে না। তখন সিংগেল লাইফে রান্নাবান্না করতে ইচ্ছে হয় না, হোটেলও ভালো করে খোলে না। খাওয়ার কষ্ট দেখা দেয়। অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। কুরবানির ঈদের পরে টানা ১০-১২ দিন প্লেট ভরে ভরে কুরবানির মাংস খেয়ে অভ্যস্ত আমি। এখন এক টুকরো মাংস নেই! প্রথম এক-দুদিনতো দাওয়াত ছিল। এখনতো তাও নেই। প্রতিবার খাওয়ার সময় দলা পাকিয়ে কন্ঠরোধ হয়। খাওয়ার জন্য এমন ক্ষুধা, তীব্র আকাক্সক্ষা ও অভিমান তৈরি হয় যে, তা বলাও যায় না, সওয়াও যায় না। বড় হয়ে গিয়েছি, আবার বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট। আমাকে এসব অভিমান মানায়? কিন্তু মানুষের ভিতরে একটি শিশু সবসময় থাকে, একটি খাদক মন সবসময় ভাবে, আর দীর্ঘদিনের অভ্যাসে গড়ে উঠা কিছু অনুষঙ্গ আমারা সহজে ভুলতে পারি না। রক্তমাংসের ষড়রিপুওয়ালা একজন দোষে গুণে মানুষ। আমিতো আর ফেরেশতা না। সেকারণে মনের গহীণ থেকে দু:খবোধ আমাদের তাড়িত করে। তখন মনে হতো, মায়ের হাতের এক টুকরো মাংস দিলে হাজার টাকা দিয়ে কিনে খেতাম। মায়ের মতো রান্না করবো বলে বাজারে যাই মাংস আনতে। কুরবানি উপলক্ষে কসাইরা মাংস বিক্রি কয়েকদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। সুতরাং কিনেও খাওয়া যাবে না। আবার বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যেখানে সেখানে দাওয়াতে যাওয়াও নিষেধ। কী আর করা। সারাদিন সারারাত ঝিম মেরে বিছানায় পড়ে থাকতাম আর বই পড়তাম। বই পড়ে পড়েই সব দু:খ দূর করতাম।
এরই মাঝে কিছু ভিক্ষুক ও টোকাই আসতো মাংস নিতে বা তরকারি নিতে। ব্যাচেলর ডরমিটরিতে একা থাকি, সেখানে আমরাই না খেয়ে থাকি। তাঁদের কোথা থেকে দিব? টাকা দিয়ে বিদায় করতাম। তবে মাংস খাওয়ার জন্য তাদের মনে যে তীব্র ইচ্ছা সেটা অনুভব করতে পারতাম। আসলে অভাবে না পড়লে অভাবীদের জীবন বোঝা যায় না। একদল লোক লাখ লাখ টাকা দিয়ে কুরবানি দিচ্ছে। আরেকদল এক টুকরো মাংসের জন্য বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। এই যে সোশ্যাল ক্লাস, এই যে বিভাজন সমাজে- তা সহজে শেষ হবার নয়। শ্রেণিসংগ্রাম ছিলো,্ আছে, থাকবে। আবার আরেকদল এই শ্রেণিসংগ্রাম পুঁজি করেই আখের গুছিয়ে নেয়।
ঈদের সময় অনেক অফিসার ছুটিতে চলে যায়। সব কাজ করতে হয় তাদের যারা স্টেশনে থেকে যায়। তাই এ সময়টা তিনগুণ কষ্ট হতো। একদিকে খাওয়ার কষ্ট ও স্বজনদের মিস করার কষ্ট, অন্যদিকে বাড়তি কাজের চাপে জেরবার অবস্থা হতো।
তবে এসব কাজের কষ্ট ও খাওয়ার কষ্ট এবং স্মৃতির কষ্টের মধ্যে কিছু আনন্দ হতো। যেসব অফিসারের পরিবার থাকেন, তাঁদের পক্ষ থেকে হুট করে বাটি দিয়ে সেমাই বা হালিম বা মাংস পাঠিয়ে দেয়। তখন দেখে চোখ ছলছল করে উঠে। কোনো কোনো কলিগ বাসায় দাওয়াত দেয় ডিনারের, তখন পুরো সন্ধ্যা কাটিয়ে রাত অবধি ভালো সময় কাটে। তাঁদের বাচ্চাদের সাথে খুনসুটি হয়, মজার মজার আরও অনেক স্মৃতি তৈরি হয়। তবে কোনো কোনো দাওয়াতে আবার একটু বেশিই খাওয়া হতো। কোনো কোনোা বাসায় খেতে গিয়ে বিড়ম্বনাও হতো। ভিন্ন অঞ্চল হওয়াতে রান্না মনমতো হতো না কিংবা ঝাল বেশি হতো। একবার আমার মতো আরেক সিংগেল কলিগসহ দুজনে খেতে গেলাম আরেক কলিগের বাসায়। তার পরিবার ইচ্ছামতো রান্না করেছে, আর আমরাও খেলাম। খাবার একটু ঝাল ছিল। আমার সমস্যা হচ্ছিল না। তবে অন্য কলিগের নাক দিয়ে পানি পড়ছিল । খাওয়া শেষেই সে বাথরুমে দৌঁড়ালো। আধা ঘন্টা পরে বিধস্ত চেহারা নিয়ে বাথরুম থেকে বের হলো।
এসেই বলে : আজ বুঝলাম। কেন বিদেশিরা বাথরুমে টিস্যু ব্যবহার করে , আর বাঙালিরা পানি ব্যবহার করে।
আমরা সবাই জিজ্ঞাসা করলাম: কেন?
আগুন কি আর কাগজ দিয়ে নেভানো যায়?, তার জন্য পানি আবশ্যক! তার সহজ জবাব!
শুনে আমাদের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে।
আরেক বাসায় দাওয়াত খেতে বসেছি। ওই বাসার ভাবি সবকিছুতে তেল বেশি দেন। পোলাওয়ে তেল বেশি হয়েছে। মাংসে ও অন্যান্য সবকিছুতে তেল ভাসছে। আমাদের এক কলিগতো মুখ ফসকে বলেই ফেললেন।
স্যার, আমাদের খুব চিন্তা হচ্ছে।
কেন?
ভাবী খাবারে এত তেল দিয়েছে, যে আমেরিকা না আবার এ তেলের খনির খবর পেয়ে যায়, আর এখন অ্যাটাক করে বসে!
শুনে ভাবীসহ সবাই হাসতে থাকে।
আবার মাঝে মাঝে এমন হতো অফিসে যেহেতু কাজ কম, সেহেতু কলিগরা মিলে দূরে কোথাও প্রকৃতি দেখতে চলে যেতাম। কয়েকটি গাড়িতে করে যেতে যেতে হৈহুল্লুর করে ভালো সময় কাটতো। পার্কে বা নদীর ধারে বা কোনো ডাকবাংলোয় বসে ¯স্ন্যাক্স বা চা কফি খেয়ে দুর্দান্ত আড্ডা ও ফান হতো। আসলে প্রকৃতি শূন্য রাখে না। কোথাও না কোথাও কোনো না কোনোভাবে আপনার নিকট আনন্দ অনষঙ্গ পৌঁছাবেই। আপনাকে কেবল গ্রহণ করতে হবে। কিংবা গ্রহণ করা ও অনুভব করা আর অনুধাবন করা জানতে হবে।
তবে সব কলিগ কিন্তু দাওয়াত দিতেন না। কিছু কলিগ খুবই কিপটে টাইপের। এক কিপটে অফিসারের বাসায় ঈদের দাওয়াত নিতে ব্যস্ত অফিসের কলিগরা।
এক কলিগ: ঈদের সময় কলিগদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো উচিত আপনার। বিশেষ করে ব্যাচেলরদের।
কিপটে অফিসার: ঠিক বলেছেন।
কলিগ: তাহলে এবার ঈদের পরের দিন রাতে আপনার বাসায় আমরা কয়েকজনের দাওয়াত। আমরা চলে আসি, কী বলেন?
কিপটে অফিসার: কিন্তু আমিতো ৬০ বছর বয়সের আগে অবসর নেবো না। এরপর ইচ্ছে হলে অবশ্যই চলে আসবেন!
এরকম কিপটে অফিসারও কিছু ছিল। তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি আবার তাদেরকে মাঝে মাঝে ভুরিভূজ করাতাম।
আরেকবার ঈদে আমি কর্মস্থলে। তখন নতুন বিয়ে করেছি। একবছর পার হয়েছে মাত্র। ছুটি মেলে নি। বউ নিয়ে ঈদ করছি স্টেশনে। গ্রামে বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন। এমনিতেই সবাইকে মিস করছি। ঈদে গ্রামের আবহ বা বৃহত্তর পারিবারিক আবহ পাচ্ছি না। তার উপর যোগ হয়েছে নানান দোষারোপ। আমি নাকি বউ নেওটা হয়ে গিয়েছি, বউ আমারে এমন তাবিজ করেছে যে ঈদেও গ্রামে আসার কথা ভুলে গিয়েছি। এ আলাপ শালাপ ঘরে, প্রতিবেশীতে ও আত্মীয়স্বজনে রটনা হয়ে হয়ে ম্যাসাকার অবস্থা। এমনিতেই কষ্টে বাঁচি না, ছুটি না পাওয়ায়, গ্রামে যেতে না পারায়। তার উপর এরকম দোষারোপ কাঁটা গায়ে লবণ ছিটানোর মতো।
আরেকবার বউ পোয়াতি, ভ্রমণ নিষেধ। আমিও গ্রামে না গেলে নানান দোষারোপ। তাই একদিনের জন্য কর্মস্থলের বাসায় সব ব্যবস্থা রেখে দিয়ে বউকে একা রেখে গ্রামে গিয়েছিলাম। প্রতিবেশী ভাবীদের জিম্মায় রেখে গিয়েছি বউকে। আগের রাত্রে গিয়ে পরের রাত্রে ফিরেছি। মাঝখানে কেবল ঈদের দিনটি। তখন আবার বউয়ের এমন অভিমান হয়েছে যে তা ভাঙাতে আমার জেরবার অবস্থা। কীভাবে জানি তা ডিসি ভাবী জেনে গিয়েছে। পরে এমনকি ডিসি পর্যন্ত ফোন করে ঝাড়ি মেরেছে। বউ ফেলে তুমি কোথায় গিয়েছো? এক্ষুণি আসো!
পুরুষ মানুষ হলে আসলে নানান ঝামেলা। শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা সারাজীবন পোহাতে হয়। আর তার সাথে সরকারিজীবী চাকুরি হন, তাহলে অর্থাভাবে ও ছুটির অভাবে আরও নানান ক্যাঁচাল পোহাতে হয়।
এসব ঘটনার মুখোমুখি হয়েই যারা ভুক্তভোগী তাদের কষ্ট অনুধাবন করতে শিখেছি। বিশেষ করে যারা ঈদে কর্মস্থলে থাকতে হয় প্রতিবছরই তাদের কষ্ট অনুধাবন করতে পেরেছি। যেমন পুলিশের কনস্টেবল, নৈশপ্রহরী, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। আর আরেকদল আছে যারা ঈদ বা কোনোসময়ই পরিবারের কাছে যেতে পারে না, গ্রামে যেতে পারে না। রাস্তায় কাটায়। রাস্তায় থাকা সেসব যাযাবর বা গৃহহীন মানুষদের কথা ভাবলে আরও অবাক লাগতো। আমরা সামান্য এ বিরহ বা ব্যতিক্রম সহ্য করতে পারি না, ওরা কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের এ বৈষম্য ও অবহেলা সহ্য করে। রাস্তায় খেয়ে না খেয়ে দিন পার করে। এমনকি ঈদেও কোনো ঈদ নেই ওদের।
নিজ জীবনের নানান ঘটনা দিয়েই নিজেকে শোধরে নিয়েছি। পরবর্তীতে যখন অফিস প্রধান হয়েছি তখন যখনই কেউ ছুটি চেয়েছে, ছুটি দিয়ে দিয়েছি। কারণ ছুটি দিলে কাজ কম হয় না, ছুটি কাটিয়ে আরও দ্বিগুণ উদ্যমে কাজ করে অফিসাররা। কলিগদের ব্যক্তিগত জীবন কোনো সমস্যায় পড়–ক তা কখনোই হতে দিই নি। বিশেষ করে যারা দায়িত্ববান ও কর্তব্যপরায়ণ কলিগ, তাদের ছুটিছাটা বিষয়ে সবসময় উদার থেকেছি। বিনিময়ে আমি আরও দ্বিগুণ কাজ এদের কাছ থেকে আদায় করতে পেরেছি।
সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা। নিজের বাড়িতে হোক , আর কর্মস্থলে হোক, ঈদ হোক আনন্দময় ও স্মৃতিময়।
লেখক: কবি ও গবেষক, (সরকারের উপসচিব)।
drshafiqul.com, [email protected]
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com