প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ৮:২৪ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ আগস্ট ৩, ২০২১, ৬:৩০ অপরাহ্ণ
কুমিল্লার উন্নয়নে ভাসে অধ্যাপক আলী আশ্রাফ– ওসমান গনি
পৃথিবীতে মানুষ জন্ম হওয়ার পর অনেকেই কর্মগুনের মাধ্যমে মরে গিয়েও চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে হাজার হাজার বছর বেচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে। পার্থিব জীবনে তারা মরে গিয়েও মানুষের মনে অমর হয়ে বেচে থাকেন চিরদিন। সে রকম একজন ব্যক্তির জন্ম হলো কুমিল্লাতে। তিনি হলেন কুমিল্লা -৭ ( চান্দিনা) আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলহাজ্ব অধ্যাপক আলী আশ্রাফ এমপি। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার দক্ষিণে গল্লাই গ্রামের মুন্সী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মরহুম ইসমাইল হোসেন মুন্সী। তিনি স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৬২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বিএ অনার্স ( স্নাতক) ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন। ১৯৬২ সালে ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়াকালীন সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ করেন।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের সংগ্রাম শুরু হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিজ মাতৃভূমি কে পাকিস্তানী হায়েনাদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য নিজের জীবনের মায়ামমতা বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেন। দীর্ঘ সংগ্রাম ও লড়াই করে দেশ কে স্বাধীন করেন। যদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০-এর পাকিস্তান সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে ‘মই’ প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। ওই নির্বাচনে জয় না পেলেও ‘মাছ’ প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ১৯৭৩ সালের প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। পরে তিনি ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের সংসদের শেষ দিকে ২০০১সালে জাতীয় সংসদের স্পিকার হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী মারা গেলে তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট আবদুল হামিদ স্পিকার নির্বাচিত হয়ে গেলে অধ্যাপক আলী আশ্রাফ তৎসময়ে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।
অধ্যাপক আলী আশ্রাফ সংসদের ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালনকালে তার দায়দায়িত্ব, সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করে সংসদের সদস্যদের ও দেশের সকল মানুষের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে দক্ষতার সহিত কাজ করার কারনে একবার বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন । তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তাছাড়া তিনি জাতীয় সংসদের সরকারী প্রতিশ্রুতি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। তার আগে তিনি অর্থমন্ত্রনালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতি করার কারনে তার মন মানসিকতা মিশে গিয়েছিল চান্দিনার সকল শ্রেনিপেশার মানুুষ ও মাটির সাথে। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে চান্দিনার মানুুষ কে এমনভাবেই আপন করে নিয়েছিলেন যে, চান্দিনার ছোটবড় সকল মানুষের নিকট আশ্রাফ ভাই হিসাবে অতি আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যখনই ঢাকাতে অবসর পেতেন ছুটে যেতেন নির্বাচনী এলাকা চান্দিনায়। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে সকল মানুষের ভালোমন্দের খোঁজখবর নিতেন। মানুষের সমস্যাদি শুনে তিনি চেষ্টা করতেন সমাধান করতে। সমাজের পিছিয়ে পরা মানুষের প্রতি ছিল তার সুদৃষ্টি। সমাজের নিন্ম শ্রেনীর মানুুষরা যাতে রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা হতে বঞ্চিত না হয় সেদিকে তার সুদৃষ্টি। তিনি সবসময় বিভিন্ন ইউনিয়নের মেম্বার চেয়ারম্যানদের একটি কথা বলে হুশিয়ার করতেন যে, গরীব লোকজন যাতে কষ্ট না পায় এবং তারা যেন রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন। কারন তিনি জানতে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া পৃথিবীতে কোন জাতি বা রাষ্ট্র বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে না। এই জন্য তার নিজ নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি নাগরিক যাতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভবিষ্যৎতে দেশ বা রাষ্ট্রে হাল ধরতে পারে সে ব্যবস্থা করেন। আগে চান্দিনাতে ছেলেমেয়েদের উঁচু শিক্ষা লাভের কোন সুব্যবস্থা ছিল না। এখানকার ছেলেমেয়েরা উঁচু শিক্ষা গ্রহন করতে হলে শহরে বন্দরে যেতে হতো। যা অধিকাংশ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই চিন্তা মাথায় রেখে চান্দিনাতে তিনি নিজ ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে তোলেন অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি ছেলেমেয়ে যাতে স্কুল, কলেজ যায় সেদিকে তার সুদৃষ্টি ছিল। তিনি চান্দিনায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য চান্দিনা উপজেলা সদরে গড়ে তুলেছেন চান্দিনা মহিলা ইউনিভারসিটি কলেজ। দোল্লাই নবারপুরে গড়ে তোলেছেন দোল্লাই নবাবপুর সরকারী ডিগ্রী কলেজ। প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, ও এতিমখানা। নির্মাণ করেছেন অসংখ্য মসজিদ। যে কারনে তিনি সবচেয়ে বেশী মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন তাহলো তিনি যেখানেই কোন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন সেখানেই তিনি একটি মসজিদ নির্মান করেছেন। যাতে করে অত্র প্রতিষ্ঠানের লোকজন নিয়মিত নামাজ আদায় করতে পারেন। ভিন্ন ধর্মাম্বলীদের জন্য গড়ে তোলেছেন তাদের উপাসনালয়। তিনি নিজেও একজন ধার্মিক ও নামাজি ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিজে নামাজ পড়তেন সকল মুসলমান কে নামাজ পড়তে আগ্রহী করে তোলতেন। তিনি চান্দিনার এমপি হলেও কুমিল্লা সর্বত্র রয়েছে তার উন্নয়নের ছোয়া।শুধু কুমিল্লা ই নয় ডেপুটি স্পিকার থাকাকালীন সময়ে সারাদেশব্যপী চষে বেড়িয়েছেন মানুষের উন্নয়নমুখী জন্য।
যোগাযোগব্যবস্থায় তিনি দেখিয়েছেন তার অসাধারণ সাফল্য। তার নির্বাচনী এলাকায় অজস্র রাস্তাঘাট নির্মান করেছেন। চান্দিনাতে এমন কোন রাস্তাঘাট নাই যেখানে পাকা নাই। সমস্ত রাস্তাঘাট তিনি পাকা করেছেন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য কাজ হলো চান্দিনা, কচুয়া ও দাউদকান্দি উপজেলার মিলিত একটি স্থান হলো ঘোগরার বিল। যেখানে হাজার হাজার একর ফসলি জমি পতিত হয়ে পড়ে থাকত। চান্দিনাতে প্রায় সময় খাদ্যের সংকট লেগে থাকত। এসব হাজার হাজার একর জমিতে কোন ফসল ফলত না। তিনি রাষ্ট্রীয় সহযোগীতা নিয়ে এই বিল কে এখন মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলেছেন। বর্তমানে মানুুষ এই বিলে এখন প্রতি বছর হাজার হাজার টন ধান উৎপাদন করে থাকে। সাথে চলে মাছের চাষ। দূরদূরান্ত থেকে বড় বড় মাছ চাষীরা এসে এখানে মাছ চাষ করে টনে টনে মাছ উৎপাদন করছে। যা এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এলাকার ভূমিহীন মানুষদের জন্য নিজ ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আবাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকার বয়স্ক, বিধবা,দুস্থ্য মানুষের জন্য ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ শতভাগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করে গেছেন।কৃষি খাতকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে তোলার জন্য কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সার,বাজ ও কীটনাশক সরবরাহ করেছেন। কৃষকরা অধিক ফলন ফলাতে পারেন। শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এই শ্লোগান কে শতভাগ বাস্তবায়ন করতে কঠোর পরিশ্রম করে বিদ্যুৎ অফিসের লোকজনদের কে সাথে নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে চান্দিনার প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে চান্দিনাকে শতভাগ বিদ্যুৎতের আওতায় নিয়ে এসেছেন। উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজার গুলোত বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় গ্রোথ সেন্টার নির্মান করে দিয়েছেন। যাতে করে ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসা করতে পারে। সরকারের বিদ্যুৎ খাত কে সাশ্রয়ী করার জন্য উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজার, রাস্তাঘাটের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সৌরবিদ্যুৎ এর স্থাপন করেছেন।
উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও মানুষের ঘরে ঘরে সোলার স্থাপন করে দিয়েছেন। যাতে করে কোন কারনে বিদ্যুৎ লাইনে গোলযোগ হলে মানুষকে অন্ধকারে থাকতে না হয়। সোলার বিদ্যুৎ পাওয়ার পর অনেক বিদ্যুৎ গ্রাহক বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ রেখে সাশ্রয়ের জন্য সোলার বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকে। এই মহান ব্যক্তি অধ্যাপক আলী আশ্রাফ এমপি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত ৩০ জুলাই/২০২১ ইং ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে বিকাল ৩:৩০ ঘটিকার সময় তার সকল নেতাকর্মীদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ( ইন্না.......রাজিউন) তার উন্নয়ন এখন চান্দিনা তথা কুমিল্লাবাসীর কাছে এখন শুধুই স্মৃতি। নিরবে নিবৃত্তে কাদে নেতাকর্মীদের মন। তারা মনে করেন নেতা মরে নাই আমাদের মনে অমর হয়ে বেচে থাকবেন চিরদিন।
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com