কুমিল্লায় ফেলে আসা দিনগুলি

আবদুল্লাহ আল মামুন।।
জীবন ! সে তো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে একটু একটু করে প্রখর হওয়া ভোরের আলোকরশ্মি কিংবা শীতের রাতে টিনের চালের টুপ-টাপ শব্দ। অল্প-স্বল্প জীবন বড়ই বৈচিত্রময়। নানা বাঁকে ভরা আমাদের ছোট জীবন। বিয়ের আসরে সদ্য পা রাখা নববধূ কিংবা বরের মতো জীবনটাকেও সাজানোর জন্য কতই না ব্যস্ততা। এর মাঝেও ফেলে আসা মুহূর্তগুলো মাঝে-মধ্যে উঁকি দেয়, সামনে আসে। নব্বইর দশকে শান্তি-সুনীতির কুমিল্লায় আমার জীবনের রঙ্গিন দিনগুলি কেটেছে। কুমিল্লার স্মৃতি আমার জীবনের পাতায় পাতায় ভরপুর।

কবির ভাষায়-
ফেলে আসা কিছু স্মৃতি, কিছু প্রিয় মুখ
ভালোবাসার আবেশ জড়ানো কিছু চেনা সুখ।
কিছু কিছু সম্ভাবনা, আর কিছু কল্পনা
বিস্মৃতির অতলে হারানো কিছু প্রিয় ঠিকানা।

কুমিল্লার কথা মনে পড়লেই যে মানুষটি পবিত্র চেহারা আমার চোখের সামনে তিনি হলেন আমার প্রিয় শিক্ষক মরহুম ফারুকী স্যার। মাধ্যমিকে তিনি ছিলেন আমাদের স্বপ্নের নায়ক। তাঁর মুখে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের গল্প শুনে প্রেমে পড়ে যাই কলেজটির। সেই সূত্রেই আমার হবিগঞ্জ থেকে কুমিল্লায় যাওয়া। ১৯৯৩ থেকে ২০০১ এ আট বছর জীবনের সেরা সময়টা মনে হয় কুমিল্লায় কাটিয়েছে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিষ্ঠান। দুই বছরের উচ্চ মাধ্যমিক, তিন বছরের অনার্স ও এক বছরের মাস্টার্স করতে গিয়ে কুমিল্লায় শুধু বন্ধুত্বের ভুবনটাই বড় হয়নি। অনেক গুণী মানুষের সাথে পরিচয় ও সম্পর্ক হয়েছে। কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তাহসিন আরা আপা, ড. শ্রীকান্ত, মোক্তার রশিদ মোল্লাসহ সকল স্যারেরা মনের আয়নায় এখনো স্পষ্ট। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দেয়ালিকা ‘তারুণ্যের স্পন্দন’আমার সম্পাদনায় বের হতো। এ ক্ষেত্রে আমাকে অকৃপণভাবে অলংকরণে সহযোগিতা করতেন সাংবাদিক রমিজ খানের ছোট ভাই রহিম খান। মাস্টার্সের ম্যাগাজিন‘ছুটি’র সম্পাদনা পরিষদের সদস্য ছিলাম। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক ও ধারবাহিক গল্প বলায় প্রথম স্থান অধিকার করে কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আমাদের সময়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতারও দলনেতা ছিলাম একবার । জাতিসংঘ তথ্য কেন্দ্র আয়োজিত ‘বর্ণবাদ বিরোধী ’ রচনা প্রতিযোগিতায় ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছিলাম। প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরী, প্রফেসর আবু তাহের ভূঁইয়া(তিতাশ চৌধরী)র মতো অধ্যক্ষ পেয়েছিলাম। মনে পড়ে নষ্ট রাজনীতির বলি হয়েছিল দুলাল নামে একজন ছাত্রনেতা। হবিগঞ্জ থেকে কুমিল্লায় যাতায়াতের আমাদের মাধ্যম ছিল ‘ট্রেন’। কতদিন যে ট্রেনের টিকেট কাটিনি তার ইয়ত্তা নেই! এটি তখন ছিল আমাদের একটা ক্রেডিটও বটে!
কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমার ছাত্র জীবনের বড় অংশ জুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল। কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত দেশের অন্যতম প্রাচীন সংবাদপত্র ‘সাপ্তাহিক আমোদ’ এর মধ্যে অন্যতম। আমোদে টুকটাক লেখালেখির সুবাদে ১৯৯৪ সালে ‘প্রুফ রিডার’ হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন আমোদ এর কর্ণধার বাকীন রাব্বী। কুমিল্লায় আমার শেষ দিন পর্যন্ত আমি স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছি। বাকীন রাব্বী একজন অসাধারণ মানুষ। মানুষকে কাছে টানার তাঁর অনন্য ও ব্যতিক্রমী কিছু গুণের কারণে পর্যায়ক্রমে তিনি বস থেকে হয়ে যান আমার ভাই আমার অভিভাবক। তার বদান্যতায় জীবনে প্রথম মোবাইল ফোনের গর্বিত মালিক হয়েছিলাম সেই ৯৭ সালেই। প্রথম পাসপোর্ট এবং প্রথম বিদেশ সফর তার মাধ্যমেই। এমন কী জীবনে প্রথম কক্সবাজার সফরও করি বাকীন ভাইর সৌজন্যেই। আমোদে ‘সুপ্রভাত কুমিল্লা’নামে আমার ধারাবাহিক প্রতিবদেনটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমাদের দেখানো পথে হেঁটেই পরবতীতে আমি প্রথম আলো, ইত্তেফাক, কালের কণ্ঠ, আজকের পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমার দেশ সেরা প্রতিবেদকের পুরস্কার পাওয়ার পেছনের শক্তির নাম আমোদ। ২০০২ সালে মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী সংসদ গঠিত হয়। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব ছিলাম। আহবায়ক ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক আবুল হাসানাত বাবুল।
কুমিল্লা বিতর্ক পরিষদ কুমিল্লায় আমার অনন্য এক স্মৃতি। বন্ধু লাভলু, টিটু, শাহজাদা, মাসুদ, কালাম, সোহেল,মাহবুব ও অন্যান্যদের সাথে নিয়ে ১৯৯৪ সালে আমরা এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করি। তখন সাংগঠনিক দক্ষতা বলতে যা বুঝায় তার ‘দ’ও আমাদের কারো ছিল না। সে সংগঠনটির পেছনে আমরা অনেক শ্রম দিয়েছিলাম। দিন নাই রাত নাই । আমরা তখন মন খোলা সহযোগিতা পেয়েছি প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরী,অধ্যক্ষ আব্দুল ওয়াহাব, অধ্যাপক হাসান ইমাম মজুমদার ফটিক, মকসুদ আলী মজুমদার, ফরিদ সিদ্দিকী, কামাল চৌধুরী, বদরুল হুদা জেনু, আবুল হাসানাত বাবুল, বশিরুল আনোয়ার, পাপড়ী বোস, সৈয়দ মোহাম্মদ বাকের, ড. আলী হোসেন চৌধুরী, জহিরুল হক দুলাল, দিলনাসি মোহসিন, সৈয়দ নুরুর রহমান, আনোয়ারুল কাদের বাকী ,বাকীন রাব্বী, ডা. দীনেশ ভট্রাচার্য,সাফেরা খাতুন, ডা, আজিজুর রহমান সিদ্দিকী,নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম, হামিদা আক্তার সুরমা প্রমুখ গুণী ব্যক্তিবর্গের। সে বিতর্ক পরিষদের হাত ধরেই আমরা আজ বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করেছি।
‘মাসিক মনন’ কুমিল্লার আরেক স্মৃতির অধ্যায়। বন্ধু শাহজাদা এমরান ছিল সম্পাদক। আমি ছিলাম বার্তা সম্পাদক। শিশুদের এই পত্রিকাটি অল্প দিনেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রধান শিক্ষকের সাক্ষাৎকার ছেপে আমরা স্কুলে স্কুলে নিয়ে যেতাম পত্রিকা। কুমিল্লার ২য় মুরাদপুরে এক সময় আমি লজিং ছিলাম। তখন প্রাইভেট পড়াতাম ব্যাংকার আমান উদ্দিনের মুরাদপুরের বাসায়। সেই বাসার আপা সময়ের ব্যবধানে মায়ার বন্ধনে আমার ‘কুমিল্লার আপা’ হয়ে উঠেছেন। স্মৃতির জানালায় কুমিল্লা ভীড় করে দারুণভাবে। শিক্ষা সংস্কৃতির পাদপীঠ কুমিল্লায় তখন ‘হাইরাইজিং বিল্ডিং’ তখন ছিল না বল্লেই চলে। ব্যাংক ট্যাংকের নগরী কুমিল্লায় আজো অনেক ব্যাংক থাকলেও ভরে গেছে অনেক পুকুর ও দীঘি। ভালো থাকুক প্রিয় কুমিল্লা।

লেখক: অধ্যক্ষ,জহুর চাঁন বিবি মহিলা কলেজ,শায়েস্তাগঞ্জ,হবিগঞ্জ।