‘কেরোসিন ঢেলে মুনার শরীরে আগুন দেয় সুমন’
মাহফুজ নান্টু
কুমিল্লার কলেজশিক্ষক তাহমিনা আক্তার মুনার মৃত্যু দুর্ঘটনার আগুনে, নাকি আগুন ধরিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে, এ নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন।স্বজনদের দাবি, স্বামীর সুনিপুণ পরিকল্পনার শিকার মুনা।
সেই রাতের ঘটনা নিয়ে সুমন যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রতিবেশীর বক্তব্যে, যিনি আগুন লাগার পর এই নারীকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে প্রায় এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মারা যান মুনা।
তার মৃত্যুর পর স্বামী সালাউদ্দিন সুমন বলেন, ৩১ আগস্ট রাত ১টায় চুলায় আগুন জ্বালাতে গিয়ে কেরোসিনের বোতল গায়ে পড়ে অগ্নিদগ্ধ হন মুনা।
চুলার পাশে কেন কেরোসিন রাখা হয়েছিল- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ঘরে বারবিকিউ করেছেন। তাই কেরোসিন ছিল।’
মুনারা ১১ বোন। মুনা দশম সন্তান। তার বাবা মারা গেছেন। মা গুলশান আরার অভিযোগ, তার মেয়ের সঙ্গে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সব তথ্য দিয়েছি। আমরা এখন সত্য উন্মোচন হবে সেদিকে তাকিয়ে আছি।’
সালাউদ্দিন সুমনের ভগ্নিপতি শওকত জামান জানান, মুনার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার রাত ৯টার দিকে পাথুরীয়াপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
প্রেম করে ২০১৭ সালে মুনা ও সুমনের বিয়ে। কিন্তু মুনার পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি। তাদের সংসারে সাফা নামে আড়াই বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
সুমনের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায়। মুনার বাবার বাড়ি কুমিল্লা নগরীর পাথুরিয়াপাড়ায়।
মুনা কুমিল্লা মডেল কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। নগরীর রেসকোর্স এলাকার একটি বাড়ির পাঁচতলায় ভাড়া থাকতেন। তার স্বামী সালাউদ্দিন সুমন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন, আবার বলতেন ফ্রিল্যান্সার। তার আয়ের উৎস নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। তবে মাজারে ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতা ছিল।
কুমিল্লা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটন জানান, ‘মুনা একজন ভালো শিক্ষক ছিলেন। খুব বেশি কথা বলতেন না। সহকর্মীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল।
বেশ কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, একাধিক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সুমনের। গোপনে একাধিক বিয়ের কথাও প্রচার হয়েছিল। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ হতো।
৩১ আগস্ট রাতে কী হয়েছিল
রাত ১টার সময় সালাউদ্দিন সুমন ফোন করেন আরেক সংস্কৃতিকর্মী স্যাম আল মামুনকে। জানান আগুনের কথা।
মামুন বলেন, ‘রাত ১টায় সুমন ভাইয়ের ফোন পাই। তিনি আমাকে বলন, তার ঘরে আগুন লেগেছে। স্ত্রী দগ্ধ হয়েছেন। খবর পেয়ে আমরা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রেসকোর্স রওনা দিই।
‘পৌঁছানোর আগেই পাশের বাসার আরেকজন নারীকে নিয়ে সুমন ভাই মুনাকে নিয়ে ঝাউতলা মুন হসপিটালে আসে। সেই হসপিটালে পুড়ে যাওয়া রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়।
‘ততক্ষণে আমরা অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দেই। তাই একটি অটোরিকশা নিয়ে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখানে বার্ন ইউনিটে মুনাকে চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় রেফার করা হয়।’
এরপর আবার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা হয় বলে জানান মামুন। বলেন, ‘সুমন ভাই ও তার স্ত্রীকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে বাসায় ফিরি। সে সময় আমার এক বন্ধুকেও পাঠিয়েছিলাম তাদের সঙ্গে।’
একাধিক সংস্কৃতিকর্মী নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, সুমন তাদেরকে ফোন দিয়ে বলেন যেন ফেসবুকে তাকে নিয়ে সবাই পোস্ট দেন। পোস্টে যেন সবাই লিখে এটা শুধুই একটা দুর্ঘটনা। অন্য কিছু নয়। তবে সুমনের এমন অনুরোধে সাড়া দেননি তার সংস্কৃতি অঙ্গনের সহকর্মীরা।
সোমবার মুনার সেই ওই বাসায় গিয়ে ঘুরে অনেক তথ্য জানা যায়। পাশের বাসার ভাড়াটিয়া মনোয়ারা বেগম বলেন, “সেদিন রাত তখন ১টা। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দরজা খুলি। দেখি সুমন ভাইয়ের স্ত্রী মুনা চিৎকার করে বলতেছে, ‘ভাবি, আমার বাচ্চা সাফাকে দেখে রাইখেন।’
“বলে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। আমি সাফাকে আমার মেয়ের কাছে দিয়ে আমিও নিচে নেমে আসি। সুমন ভাই পরে নিচে নামেন। আমি চেয়ে দেখলাম মুনার শরীর ভয়ংকরভাবে পুড়ে গেছে।”
সুমন যে নারীকে নিয়ে হাসপাতালে যান বলে মামুন বলেছিলেন, তিনিই মনোয়ারা।
আগুন কীভাবে লাগল, তা নিয়ে সুমন ও তার বক্তব্যে বিস্তর ফারাক। তিনি বলেন, ‘ওই দিন বাসায় কোনো সিলিন্ডার বিস্ফোরণ শুনি নাই। সুমন ভাই যে বলছেন বাসায় বারবিকিউয়ের আয়োজন করেছে, তাও দেখি নাই।’
কুমিল্লার মুনা কি হত্যার শিকার?
পরদিন সুমনের মা শামীমা আক্তার ও কাজের মেয়ে এসে তাদের ঘর পরিষ্কার করেন বলেও জানান মনোয়ারা। জানান, তারা যাওয়ার সময় সাফাকে তার কাছ থেকে নিয়ে যান।
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সহকারী রেজিস্ট্রার আমিনুর রশীদ বলেন, ‘রোগীর (মুনা) বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত পুড়ে গিয়েছিল। বলা যায় শরীরের ৬৬ ভাগ পুড়েছে। এত বেশি পুড়ে যাওয়ায় আমরা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় রেফার করি।’
মুনার পরিবারের নানা সন্দেহ
মুনার বড় বোন মাসুমা বেগম বলেন, ‘অনেকগুলো ঘটনা আমাদের কাছে সন্দেহজনক। আমরা সব বলেছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।’
কী কী সন্দেহজনক মনে হয়েছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জানাব, পুলিশ তদন্ত শেষ করুক। আমাদের মুনার মেয়ে সাফা এখন তার দাদির কাছে আছে। আমরা সাফাকে নিয়ে শঙ্কিত।’
মুনার বড় বোন মাসুমা খাতুন বলেন, ‘আমার বোন হসপিটালে থাকতে সব বলে গেছে। ওই দিন রাতে সুমন তার ফ্ল্যাটের পানির লাইন অফ করে দেয়। পরে কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় মুনার শরীরে।’
তিনি এও জানান, হাসপাতালে সুমন তার মেয়েকে হত্যার ভয় দেখিয়ে তার ম্তৃ্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়- এ কথা বলতে বাধ্য করেছে এবং সেই বক্তব্য ভিডিওতে ধারণ করেছে।
মুনা মারা যাওয়ার পর তার লাশ গ্রহণ করতেও সুমন যাননি বলে জানান মাসুমা।
সুমন কেন এই কাজ করেছেন, সে বিষয়ে মুনা কিছু বলে গেছেন কি না- এমন প্রশ্নে মাসুমা বলেন, ‘সুমন বেকার ছিল। ব্যবসার কথা বলে ১০ লাখ টাকা যৌতুক চায়। এই টাকা না পাওয়ায় সে মুনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
‘ঘটনার আগের দিন ৩০ আগস্ট মুনা আমাদের আরেক বোন তারান্নুম ঝিলিকের কাছে ফোনে জানায়, শাশুড়ি শানিমা বেগম তাকে খুব গালাগাল করছে।’
মুনার মৃত্যুর পর সুমন হাসপাতাল থেকে চলে যান বলে জানান মাসুমা। তিনি বলেন, ‘তার জন্য আমরা মরদেহ নিয়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করি। পরে মরদেহ নিয়ে চলে আসি।’
পরে সুমন মুনার জানাজায় হাজির হলেও দ্রুত চলে যান বলে জানান মাসুমা। বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সুমনের কোনো খবর নেই।’
এসব অভিযোগ নিয়ে সুমন বলেন, ‘এসব ষড়যন্ত্র।’
তাহলে কীভাবে এ ঘটনা ঘটল- এমন প্রশ্ন করার পর ব্যস্ততার অজুহাতে ফোন রেখে দেন তিনি।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সহিদুর রহমান জানান, ‘মঙ্গলবার আমরা একটা অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি।’