ক্ষমতা যার ইতিহাস তার!

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশের ইতিহাস কখনোই কেবল কাগজে লেখা কোনো গল্প নয়। এটি রক্তে রাঙানো, আত্মত্যাগে ভেজা এক জাতির সংগ্রামের দলিল। অথচ এই ইতিহাস বারবার বিকৃত হয়েছে। ১৯৭১ সালের বিজয়ের পর থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রতিটি অধ্যায়ে দেখা গেছে—ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী নিজেদের মতো করে ইতিহাস লিখেছে। আজ তাই আমাদের হাতে সত্য ইতিহাস নেই, বরং “ক্ষমতার দলিল” পড়তে হচ্ছে।
বিজয়ের আনন্দ ও বাস্তবতা (ডিসেম্বর ১৯৭১ – ১৯৭২)
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর বিজয়ের সূর্যোদয় বাঙালির শতাব্দীর স্বপ্ন পূরণ করে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা জাতিকে এক অনন্য মর্যাদা দেয়। কিন্তু খুব শিগগিরই দেখা গেল—যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা, শরণার্থীদের দুর্দশা, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি। স্বাধীনতার স্বপ্ন তখনই প্রথম ধাক্কা খায়।
দুর্ভিক্ষ ও হতাশা (১৯৭৪)
স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালে দেখা দিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ মারা গেলেন। পাঠ্যপুস্তক এটিকে প্রায়শই প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী—এটি ছিল প্রশাসনিক অদক্ষতা, বাজার সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির সরাসরি ফলাফল। স্বাধীনতার স্বপ্নের কবর তখনই খুঁড়ে যায় সাধারণ মানুষের চোখে।
হত্যাকাণ্ড ও সামরিক শাসন (১৯৭৫)
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির জনকের এই নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে ঠেলে দেয় অন্ধকার টানেলে। এরপর শুরু হয় অভ্যুত্থান-প্রতিঅভ্যুত্থান, সামরিক শাসন ও ক্ষমতার দখলযুদ্ধ। ইতিহাসের বই থেকে বঙ্গবন্ধুকে প্রায় মুছে ফেলা হয়। ক্ষমতা দখলদারদের কলমই তখন সত্যকে ঢেকে রাখে।
সামরিক আধিপত্য ও গণআন্দোলন (১৯৭৫–১৯৯০)
এক যুগেরও বেশি সময় সামরিক শাসনের তাণ্ডবের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ। উন্নয়নের প্রচারণা চলেছে, কিন্তু আড়ালে চলছে দমননীতি, গুম-খুন, নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে পতন ঘটে এরশাদের। আজও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের কৃতিত্বকে বড় করার জন্য ইতিহাসকে একক করে নিতে চায়। বাস্তবতা হলো—জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই এর মূল কারণ।
গণতন্ত্রের পুনরারম্ভ ও সহিংসতা (১৯৯১–২০০৬)
৯০–এর দশকে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে। কিন্তু খুব শিগগিরই গণতন্ত্রের চর্চা রূপ নেয় হরতাল, অবরোধ ও সহিংস রাজনীতিতে। ২০০১–২০০৬ সময়কাল বিশেষভাবে রক্তাক্ত ছিল। রাজনৈতিক সন্ত্রাস, গ্রেনেড হামলা, হত্যা ও বিভাজন ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে। সরকারি ইতিহাস প্রায়ই এই অধ্যায় আড়াল করে রাখে—কারণ ক্ষমতাসীনদের হাত তখন এই অপরাধে রঞ্জিত ছিল।
দীর্ঘ ক্ষমতার রাজনীতি (২০০৮–২০২৪)
২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন এবং পরবর্তী ১৬ বছর দেশ শাসন করেন। একদিকে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। অন্যদিকে ইতিহাসের বিবরণ হয়ে ওঠে একমুখী। শেখ মুজিবকে সর্বত্র প্রচার করা হয় জাতির জনক হিসেবে, আর জিয়াউর রহমানসহ অন্যান্য নেতাদের অবদান প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। রাষ্ট্র, পাঠ্যপুস্তক, গণমাধ্যম—সবই হয়ে ওঠে ক্ষমতার হাতিয়ার।
জনঅভ্যুত্থান (২০২৪)
২০২৪ সালে ছাত্র-যুব সমাজের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তবর্তীকালীন সরকার। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল এবার ইতিহাস নিরপেক্ষভাবে লেখা হবে। কিন্তু বাস্তবে শুরু হলো নতুন ইতিহাস পুনর্লিখন। শেখ মুজিবকে আড়ালে রেখে সামনে আনা হলো জিয়াউর রহমানকে। ভারতের ভূমিকাও হালকা দেখানো হলো। আবারও ইতিহাস ঢেকে গেল রাজনৈতিক মিথ্যে ও প্রচারণার আড়ালে।
২০২৫ সালের নির্মম সত্য
আগস্ট ২০২৫—শেখ মুজিবের বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। নতুন পাঠ্যপুস্তকে ঢুকেছে নতুন ব্যাখ্যা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া খবর, গুজব ও মিমে ইতিহাস ছেয়ে গেছে। ১৯৫২ থেকে ২০২৫—প্রতিটি অধ্যায়েই ক্ষমতার কষাঘাত লেগেছে ইতিহাসের শরীরে।
ইতিহাসের বিকৃতির ধারা
বাংলাদেশের ইতিহাস গৌরবময়, কিন্তু বারবার বিকৃত হয়েছে।
- একদল শহীদ সংখ্যা বাড়িয়ে বলেছে, অন্যদল কমিয়েছে।
- দুর্ভিক্ষকে বলা হয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
- ছাত্র আন্দোলনকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
- নির্দিষ্ট নেতাকে বড় করার জন্য অন্য নেতাকে আড়ালে রাখা হয়েছে।
ফলাফল—জাতি বিভক্ত, বিভ্রান্ত ও দুর্বল।
ক্ষমতা যার, ইতিহাস তার। কিন্তু সত্য ইতিহাস ছাড়া কোনো জাতি এগোতে পারে না। জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে—
১. নিরপেক্ষ গবেষণা
২. প্রমাণভিত্তিক ইতিহাসচর্চা
৩. রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন
কারণ, ইতিহাস কেবল শাসকের দলিল নয়—এটি জাতির আত্মপরিচয়। সত্য ইতিহাসই জাতির বেঁচে থাকার শর্ত।
তথ্যসূত্র
১. Wikipedia – ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৪ দুর্ভিক্ষ, ১৯৮৩ ছাত্র আন্দোলন, ১৯৯০ গণআন্দোলন
২. Amartya Sen, Poverty and Famines (1981)
৩. Rounaq Jahan, Bangladesh Politics: Problems and Issues (1980)
৪. Lifschultz, Bangladesh: The Unfinished Revolution (1979)
৫. Human Rights Watch Reports (2002–2006)
৬. The Diplomat, FT, Asia Times (2021–2024)
৭. Daily Star Archive
