প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২২, ২০২৪, ৮:২৫ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ মে ২৬, ২০২৪, ৬:১৬ অপরাহ্ণ
।। এইচ.এম. সিরাজ ।।
১১ জ্যৈষ্ঠ। নজরুল জয়ন্তী। আর যাই হোক না হোক, অন্তত একটি কারণেই এই দিনটি ঐতিহাসিক। আজ প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম বা সোয়াশ' তম জন্মবার্ষিকী। শতাধিক বছরেরও আগে, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ মোতাবেক ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে তারিখে তিনি জন্মেছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মালেও তিনিই আমাদের জাতীয় কবি। তবে 'নজরুল আমাদের জাতীয় কবি' এই কথাটি কেবলই মৌখিক, দালিলিক নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পাঁচ বছর বেঁচে-বর্তে থাকান্তে জীবনাসানের চার দশক অতিক্রান্তের পরও কবি নজরুলকে আমাদের জাতীয় কবির দালিলিক প্রমাণ দিতে না পারা আমাদেরই চরম ব্যর্থতা-লজ্জা। কাজী ফকির আহমেদের ঔরষে এবং মাতা জাহেরা খাতুনের জঠরে জন্মানো সেই 'দুখু মিয়া'-ই দ্রোহ ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
--
হয়তোবা তেমন হাকডাক নেই। তথাপিও আজ জাতীয় কবির জন্মদিন। ব্যক্তি জীবনে কবি নজরুল আমৃত্যুই ছিলেন জাতীয় জাগরণেরও অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। আমাদের দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক কবি নজরুলকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসা, নাগরিকত্ব প্রদান, এমনকি কবির অন্তিম ইচ্ছানুসারেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তিনাকে করা হয় সমাহিত। কিন্তু বড্ড পরিতাপের বিষয়, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের 'জাতীয় কবি' এই বিষয়ে আজ অবধি কোনো সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এমনটি আমার অন্তত অজানা! কেবলই মুখে মুখে আর কালির আঁচরে লেখাতেই তিনি আমাদের 'জাতীয় কবি'! অথচ সরকারি নথিপত্রে তিনি আমাদের জাতীয় কবি নন! কেন?? এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের এতোগুলো বছর লাগছেই-বা কেন??? এহেন দৈন্যতার দায়ভারটা খুবই পীড়াদায়ক।
--
❝ আমায় নহে গো- ভালোলবাসো শুধু,
ভালোবাসো মোর গান।
বনের পাখিরে কে চিনে রাখে-
গান হলে অবসান! ❞
কারই-বা সাধ্য এমনটি রচিবার? আজন্ম ক্ষ্যাপাটে ছাড়া কি আর কারো কাছে এমনটি আশা করা যায়? সেই আজন্মকালের ক্ষ্যাপা-কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ধূমকেতু' নামে খ্যাত কবি নজরুল তাঁর গীতবার্তায় অনেকটা এমনটিই বলে গিয়েছিলেন। তিনি সত্যিই জানতেন, চলে গেলে কতো আর পাবেন! যিনি আজীবন গোটা জাতিটাকে স্বাধীনতার মন্ত্রে করে গেছেন উজ্জীবিত, আমৃত্যু কাটিয়ে গেলেন সংগ্রামে, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দেবার প্রয়াসে জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ দূরীভূতের কঠিন সংগ্রামে ঝাঁপ দিয়েছিলেন - তাঁর তো সেই একটা দিনই জাতির কাছে পাওনা। আর তা হলো ১১ই জ্যৈষ্ঠ। রীতিমতো বকতালীয়ই বটে, এবারও দু'দিক দিয়েই দিনটি মিলেমিশে হয়ে গেছে একাকার। সেবার যবে ধরাধামে এসেছিলেন তিনি, সেদিনও ছিলো ১১ জ্যৈষ্ঠ তথা ২৫ মে। একশ' চব্বিশ বছরের মাথায় এসে হুবহুই মিলে গেলো বঙ্গাব্দ আর খ্রিস্টাব্দের হিসেব! তবুও কবি নজরুল চিরতরেই বাঙালির, জয়তু নজরুল।
নজরুল যদিও 'দ্রোহের কবি' হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত তথাপি তিনি প্রেম, মানবতাবাদ, সাম্য, মুক্তি আর বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়েই লড়ে গেছেন আমৃত্যু। তিনি আসলে কী করেন নি? ল্যাটোর দলে গান গাওয়া, রুটির দোকানে চাকরি করা, জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া, কিশোর-যুবাদেরকে নিয়ে আড্ডায় মাতোয়ারা হওয়া, সৈনিক হয়ে যুদ্ধে যাওয়া, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করা, জেলে গিয়েও মুক্তি আদায় করা, গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে অসহায়দের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা, সাংবাদিকতা, সম্পাদনা, অভিনয়, সঙ্গীত রচনা- এমন কোন্ কাজটি তিনি করেন নি? আর তাইতো তিনি আমাদের জাতীয় কবি।
--
❝ আমি তাহাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। ❞
আসলেও ঠিক তাই-ই। তিনি সেসবই করেছেন, যাতে আসে মানবতার মুক্তি। সদায়ই তিনি গেয়েছেন মুক্তির জয়গান, ভাঙ্গার গান। কোনোরূপ শাসন-ত্রাসনই তাঁকে একটুর জন্যও দমিয়ে রাখতে পারেনি। কেননা, তিনি তো ছিলেন সকল নিয়ম ভাঙ্গার এক মহা ওস্তাদ। কোনো রকমের নিয়মের বেড়াজাল-ই তাঁকে আটকাতে পারেনি। কারণ তিনিই লিখেছেন-
❝ আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী
আমি রণদা সর্বনাশী
আমি জাহান্নামের আগুণে বসিয়া
হাসি পুষ্পের হাসি। ❞
--
যৌবনের কিছুকাল তিনি কাটিয়েছেন কুমিল্লায়। রাণীর দীঘির পাড়ে, ভিক্টোরিয়া কলেজ অঙ্গনটায় নিয়মিতই জমাতেন আড্ডা। আমার সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয় স্মৃতিচিহ্ন করে রাখা সেই আড্ডাস্থলটি। দুইটি স্টোনে খোদাইকৃত লেখার পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি ধারণ করারও সুযোগ ঘটেছে বলে আমি ধন্য- আপ্লুত। স্টোনে লেখা 'কুমিল্লায় থাকাকালীন সময়ে (১৯২১-১৯২৩ খ্রি.) কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় প্রতিদিনই এখানে বসেই কলেজ পড়ুয়া তরুণদের নিয়ে কবিতা-গানের আসর জমাতেন।' তাঁর 'মাধবী লতা দোলে--------- এবং আরো কয়েকটি গান এখানটাতেই রচিত। প্রেমিক নজরুল এইখানে বসেই তাঁর প্রেমিকা-প্রিয়তমা প্রমিলা দেবীকে চিঠি লিখতেন। কবিতার ছন্দেভরা সেই চিঠি নজরুলের সুহৃদদের মাঝেও আনন্দের সঞ্চার করতো।
--
❝ তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি- আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর ও কুৎসিতের সাধনা আমার নয়।আমার আঘাত বর্বরের এমনকি কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামীই জানেন (তুমি কি জানো বা শুনেছো জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই। ❞
এটি কবি নজরুলের পত্রাংশ। বিচ্ছেদ ঘটার সুদীর্ঘ ১৫ বছর পর প্রথম এবং শেষবারের মতো নার্গিসকে লেখা একখানা পত্রে উপরোক্ত কথাগুলোই লিখেছিলেন কবি নজরুল। কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের সৈয়দা খাতুন ওরফে দুলি'র সাথে বৈবাহিক বন্ধনেও আবদ্ধ হয়েছিলেন কবি নজরুল। তিনি নিজে সৈয়দা খাতুনের নাম রেখেছিলেন নার্গিস আসার খানম। তবে এই বিয়েটির পেছনে ছিলো আলী আকবর খানের সূক্ষ্ম বাণিজ্যিক কার্যক্রম! আর এমনটি বুঝেছিলেন বলেই নার্গিসের সাথে আয়োজিত বাসর থেকেই পালিয়েছিলেন কবি নজরুল। দৌলতপুর গ্রামটিতে কবি নজরুলের কোন স্মৃতি মুছে যায়নি, বরং বেড়েছে। আমার এক পরম প্রিয়জনের অনুপ্রেরণাতেই আমাকে দৌলতপুর যেতে হয়েছে বহুবার।গিয়ে বুঝেছি, কেনই-বা দৌলতপুর গ্রামটি 'কবিতীর্থ দৌলতপুর' নামে পরিচিত। যেই ঘরে নজরুল-নার্গিসের বাসর সাজানো হয়েছিলো, সেটির সামনে স্থাপিত হয়েছে স্মৃতিফলক। পার্শ্ববর্তী আরেকটি ঘরে আজও স্মৃতি করে রাখা কবি নজরুল-নার্গিসের বাসর'র জন্য সাজানো ঐতিহ্যমণ্ডিত সেই পালঙ্ক। নার্গিসদের বাড়ির দক্ষিণের পুকুরপাড়ের আম্রতলায় বসেই একদা কবি রচেছিলেন তাঁর বিখ্যাত একখানি কবিতা। সেই আম্রতলার অবয়ব ন্যায় একটি বেদি এবং পাশেই স্থাপিত 'পাপড়ি খোলা' স্মৃতিফলক কবি নজরুলের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। এর খানিক দক্ষিণের মাঠে নজরুল মঞ্চ। এসব মিলিয়ে দৌলতপুর যেনো কবি নজরুলেরই গ্রাম। আর এজন্যই গ্রামটি 'কবিতীর্থ দৌলতপুর' নামে সমধিক পরিচিত।
--
কবি নজরুল ইসলাম একবার আইনসভার প্রার্থী হয়ে ভোট চাইতে হাজির হয়েছিলেন এক মৌলভির বাড়িতে। কবিকে দেখে আঁতকে উঠেন মৌলভি। 'এ কি! আপনি তো কাফের! একজন কাফেরকে তো ভোট দেয়া যায় না!' মৌলভির কথায় সায় দিলেন তার সাথীরাও। কিন্তু এমন আচরণেও কবি শান্ত ও স্থির গলায় বললেন, 'মৌলভি সাহেব! কাফের বলেছেন তাতে দু:খ নেই। এর চেয়েও কঠিন কথা আমি শুনেছি।শুনতে হয়েছে অনেক জঘন্য কথাবার্তাও। তবে আপনার বাড়ি যখন এসেছি, আপনায় একটি কবিতা না শুনিয়ে চলে যাই কিভাবে?' নজরুল তাঁর আবৃত্তির ডালা খুলে বসে শোনালেন তাঁর বিখ্যাত ‘মহররম’ কবিতা। কবির ভরাট গলার উচ্চারণে তৈরি হয় এক অপার্থিব আবেগ ও হৃদয়ছোঁয়া বেদনার পরিবেশ। এবার নত হয়ে এলো মৌলভি তমিজুদ্দীন এবং তার সাথীদের মাথা। এই কি নজরুল! কি অপূর্ব তার কবিতা। কত গভীরে এর বেদনা! আহা! এমন করে তো আর কেউ কবিতা শোনায়নি। মৌলভি সাহেব এবং তার সাথীরা অনুতপ্ত হয়ে পরম আদর-যত্নে বরণ করে নিলেন কবিকে।
--
একদা এক হিন্দু বন্ধুর আমন্ত্রণে তার বিয়ের আসরে হাজির হলেন কবি নজরুল। কবিসহ বরযাত্রীদের সবাই আহারের অপেক্ষায়, কিন্তু খাবার আসছে না। ভেতর থেকে প্রশ্ন এসেছে, বরপক্ষের সাথে একজন মুসলমান এসেছে কেন? অন্দরমহলের মেয়েরা খাবার পরিবেশন করবে না! মুসলমানকে বিদায় করতে হবে। নজরুলকে সাথে নিয়ে যাওয়া বন্ধুরা লজ্জায় লাল। অভিমানী নজরুল হিন্দুদের এমন সংকীর্ণ আচরণ আর জাতের কদর্য রূপ দেখে ব্যথিত হলেন, বেশ কষ্ট পেলেন। মনের ক্ষোভ নিয়ে একটি কবিতা লিখে সবাইকে শুনিয়ে দিলেন। কবিতার সূচনা অংশ, 'জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছে জুয়া/ ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া?' মুসলমান কবি নজরুলের মুখে এমন অগ্নিজ্বালা প্রতিবাদ শুনে নীচু হয়ে এলো সবার মাথা। অভিমানী নজরুল তাঁর কবিতা শুনিয়ে মলিন মুখে পা বাড়ালেন,সেই বিয়েবাড়ি থেকে চলে এলেন।
--
❝ কেউ বলেন আমার বাণী যবন,
কেউ বলেন কাফের'র।
আমি ও দু'টোর কোনটাই না,
আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে
এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যাণ্ডশেক করিয়ে
গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার
চেষ্টা করেছি মাত্র। ❞
-এই লেখায় তিনি আসলে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন? তিনি কী সাম্প্রদায়িক নাকি সমাজের আর দশজনের চাইতেও অনেক গুণ বেশিই অসাম্প্রদায়িক? তথাপিও কাজী নজরুলে প্রতি আমাদের মনের দৈন্যতা যেনো আজও গেলোই না!
❝ গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ,
অভেদ ধর্মজাতি
সব দেশে সব কালে,
ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। ❞
সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে নজরুলের প্রাণান্তকর সংগ্রাম, সাম্য ও মুক্তির বাণী বর্তমান প্রেক্ষাপটে আরো অনেক বেশিই প্রাসঙ্গিক। পরিশেষে কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতির প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন এবং নিজের প্রতি অনেকটা ধিক্কার জানিয়ে শুধু দু'টো লাইন উচ্চারিত করতে চাই, যদিও আমি নই কবি।
'আমার একবুক কষ্ট এই ব্যাটাকে নিয়ে
তাঁর সবই নিলাম তাঁকেই কিছু না দিয়ে!'
------ক্ষমা করিও মোদের ভুল, জয়তু নজরুল।
#
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।