বাংলাদেশ কি আবার অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছে?
।। মনোয়ার হোসেন রতন ।।
ভূমিকা
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হতে পারত। কিন্তু এক বছর না যেতেই দেখা যাচ্ছে, দেশ আবারও রাজনৈতিক বিভাজন, দায়িত্বহীন নেতৃত্ব, এবং সংঘাতমুখী কৌশলের শিকার হচ্ছে। এমন এক পটভূমিতে যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুস পদত্যাগ করেন বা রাজনৈতিক অস্থিরতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তাহলে কি দেশ আবার মার্শাল ল-এর মুখে পড়বে? প্রশ্নটি এখন আর কল্পনা নয়, বাস্তব আশঙ্কা।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: উত্তাল গণমানস ও দলীয় দুর্বৃত্তায়ন
২০২৪ সালের শুরুতে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান মূলত ছিল একগুঁয়ে দলতন্ত্র, নির্বাচন প্রক্রিয়ার অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এতে দেখা গেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণ। পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল এ দাবিকে সম্মান জানিয়ে।
তবে গত এক বছরে রাজনৈতিক দলগুলো সেই গণআন্দোলনের স্পিরিট ধারণ না করে আবারও একে অপরকে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আলী রিয়াজ বলেন, "বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বারবার পতনের মূল কারণ একচেটিয়া রাজনীতির সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আপসহীনতা" (সুত্র: ইউনাইটেড নিউজ, মার্চ ২০২৫)। এ পরিস্থিতিতে যদি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তা হবে জনগণের প্রত্যাশার পরিপন্থী, ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘোরানো।
সামরিক শাসনের পুরনো অভিজ্ঞতা: ইতিহাস কী বলে?
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে তিনবার সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ হয়েছে:
১. ১৯৭৫ – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সামরিক শাসনের সূচনা।
২. ১৯৮২ – এরশাদের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল ও নয় বছরের স্বৈরশাসন।
৩. ২০০৭ – তথাকথিত 'ওয়ান-ইলেভেন' এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনা-সমর্থিত শাসন।
এই প্রতিটি উদাহরণে দেখা গেছে, প্রথমে জনসমর্থন থাকলেও শেষপর্যন্ত তা রূপ নিয়েছে দমন-পীড়ন ও জবাবদিহিহীন শাসনে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, "সামরিক শাসন কখনোই গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না; বরং তা রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়।"
সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রভাব
রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং সংবিধান আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বাতিল হতে পারে। এতে দেশের দীর্ঘমেয়াদী সাংবিধানিক কাঠামো বিপর্যস্ত হবে। রাজনৈতিক দলসমূহ আবারও আতঙ্কের মধ্যে পরিচালিত হবে, বিরোধী মত দমন ও মিডিয়া সেন্সরশিপ বাড়বে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া: এক শাসনে, বহু আতঙ্ক
মার্শাল ল আসলে জনমনে আস্থার সংকট বাড়বে। সামাজিক আন্দোলন, নাগরিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে। দেশের তরুণ সমাজ, যারা ২০২৪ সালের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল, হতাশ হবে ও রাজনৈতিক নির্বাসনে যেতে পারে। নারীর নিরাপত্তা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার, এবং জাতিগত বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীলতা হ্রাস পাবে।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট: অস্থিরতার ফাঁদে প্রবেশ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF), বিশ্বব্যাংক, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে ২০২৪-এর আন্দোলনের পরে 'গভর্ন্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট' প্রজেক্টে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যদি মার্শাল ল জারি হয়, তবে এ সমস্ত প্রজেক্ট ঝুলে যাবে।
এছাড়া—
বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারাবে, ফলে বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাবে।
বেকারত্ব বাড়বে, রপ্তানি খাত ধাক্কা খাবে।
রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ সংকট প্রকট হতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মূলত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করে। সেনা শাসন বিনিয়োগকারীদের চোখে অস্থিরতার প্রতীক।" (সুত্র: দ্য ডেইলি স্টার, ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
উপসংহার: ফের গণতন্ত্রের পথে ফিরব কি?
২০২৪ সালের গণআন্দোলন যে আশা জাগিয়েছিল, তা আবারও ভেসে যেতে বসেছে। এই মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে অহমিকা ত্যাগ করে একটি ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছানো, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে তার মূল উদ্দেশ্য সফল করার সুযোগ দেওয়া।
মার্শাল ল কোনো সমাধান নয়; এটি কেবল গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক মর্যাদাকে দীর্ঘমেয়াদে বিপন্ন করবে। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে—“সামরিক শাসন কখনো দীর্ঘস্থায়ী স্থিতি দিতে পারে না, বরং সংকটকে গভীরতর করে।”