মাহফুজ নান্টু।।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তার চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। বুঝলাম এই বোবা প্রাণিটা সব বুঝে গেছে। আজ তাকে হাটে নেয়া হবে। দুদিন পর কোরবানির ঈদ। যতদূর মনে হয় তখন তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। এই ষাড়টার সাথে আমার অনেক বছরের সম্পর্ক। তার মা ছিলো আমাদের পরিবারের বিশ্বস্ত প্রাণী। সাদা শরীর, বিশাল শিং। প্রতিবেশীরা বলতো এটা অস্ট্রেলিয়ান গাভী। আমার দাদা প্রয়াত বাচ্চু মিয়া বলেছিলেন, এই গাভীটা তিনি লালমাইয়ের এক গৃহস্থ থেকে কিনেছিলেন। অনেক বছর ধরে আমাদের একান্নবতী পরিবারে দুধ সরবরাহ করেছিলো গাভীটা। ছোট বেলায় অনেক দুষ্ট ছিলাম। গাভীটার ওলান মুখে দিয়ে কত দুধ খেয়েছি। গাভীটার সবশেষ যে বাচ্চাটা দিয়েছিলো সেটা এই ষাড়। যাকে আজ গোছল করানো হলো কোরবানির হাটে নেয়ার জন্য।
এই ষাড়টার জন্মের বছরখানেক পরে অজ্ঞাত রোগে তার মা মারা যায়। চারজনে মিলে বাঁশের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে গাভিটাকে দূরে ধানি জমির মাঝে ফেলে আসে। আমি পেছনে পেছনে যাই। কসাই খবর পায়। কসাই ছুরি দিয়ে চামড়া তুলছে। আকাশে উড়ছে একদল শকুন। শকুনগুলো চক্কর দিচ্ছে। চামড়া তুলে নেয়ার পর শুকুন আর একদল কুকুরকে দেখলাম মুর্হূতেই আমার সেই চিরচেনা গাভীটাকে খেয়ে ফেলে। শুধু হাড্ডিগুলো পরে রইলো। কি এক অমোঘ মায়ার সন্ধ্যায় আবার যাই সেই জায়গায়, দেখি গাভীর হাড্ডিগুলো নিয়ে টানাটানি করছে একদল শেয়াল।
যে কথা বলছিলাম। মা হারিয়ে বাচ্চা ষাড়টা অনেক দিন কিছুই খায়নি। খাবার মুখে তুলে দিলে খেতো। আমার শৈশব আর ষাড়টার শৈশব মিলে মিশে একাকার। স্কুল থেকে ফিরেই, ষাড়টা আদর করে মাঠে খেলতে যেতাম। আমার বড় হওয়ার আগে ষাড়টা বড় হয়ে গেলো। তেজস্বী হিং¯্র, বড় শিং, তাগড়া শরীর। ওরে গোছল করাতে কমপক্ষে তিনজনকে পরিশ্রম করতে হতো। এই ষাড়টার সামনে কেউ গেলে ফোঁস ফোঁস করতো। অথচ আমি গেলেই কেমন মিইয়ে যেতো। জিহ্বা দিয়ে আমার কপালে লেহন করতো। এভাবে কত দিন গেলো, কত রাত গেলো। আমি ছোট রইলাম। ষাড়টা বড় হয়ে গেলো। টানা চোখ, সুঠাম দেহ। গায়ের রঙ লাল, কালো শিং। কি এক রাজকীয় ভাবসাব।
ষাড়টাকে গোছল করানো হলো। নতুন রশি দিয়ে বেঁধে হাটে চললো। আমি পেছনে পেছনে। কাউকে বুঝাতে পারবো না, আমার বুক ভেঙে কান্না আসছিলো। হাটে নেয়ার পরে, সাথে করে নিয়ে যাওয়া কিছু খড় দিলাম। ষাড়টা মুখে নিলো। পরম নির্ভরতায় খড় চাবাতে লাগলো। হাটে তোলার আধঘন্টার মধ্যেই ষাড়টা বিক্রি হয়ে গেলো। কোন ভাবেই নিজের মনকে বুঝাতে পারছি না। যারা ষাড়টাকে কিনেছেন, তারা ষাড়টাকে নিতে পারছিলো না। এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছিলো। আমি পাশে থাকা এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে দুটো কাগজের রঙিন মালা কিনলাম। একটা মালা শিংয়ে পরিয়ে দিলাম, আরেকটা গলায়। পরম আদরে গলায় জড়িয়ে ধরলাম। শান্ত হলো ষাড়টা । আমি স্পষ্ট দেখেছি তার চোখে পানি। এবার সে হেটে হেটে ক্রেতার সাথে চলে যাচ্ছে। আমি চেয়ে আছি...কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিলো।
লেখক:কুমিল্লা প্রতিনিধি,এনটিভি।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com