।। মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী।।
ভিসা সিটি ’সেনজেন’
ইউরোপীয় ইউনিয়েনের ২৭ টি দেশের মধ্যে ’শেনজেন’ ভিসা কার্যকরী। অর্থাৎ এই শেনজেন ভিসা নিলে ইউরোপের ২৭ টি দেশের মধ্যে অবাধে চলাফেরা করা যায়। আজ থেকে প্রায় ৩৯ বছর আগে ১৯৮৫ সালে ১৪ জুন তারিখে বেনোলাক্স ইকোনমিক ইউনিয়ন, ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি ও ফরাসি প্রজাতন্ত্রের রাজাগুলোর মধ্যে এই শেনজেন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাদের সাধারণ সীমানায় চেকপোস্টগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করার বিষয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় লুক্সমেবুর্গের ‘শেনজেন’ শহরে। ঐ শহরের নামেই এ চুক্তি। এটি কার্যকর হয় ২৬ মার্চ ১৯৯৫ সালে। মূল স্বাক্ষরকারী দেশগুলো ছিল: বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী, লুক্সেমবুগ, নেদারল্যান্ড। এর আমানতকারী হলো লুক্সেমবুর্গের গ্রান্ড ডাচি সরকার। বর্তমানে প্রায় ৪০০ মিলিয়নের বেশী জনসংখ্যা ও ৪৩ লক্ষ ১২ হাজার ৯৯ ব.কিমি এলাকার এর আওতাভূক্ত। ইউরোপীয় মহাদেশে শেনজেনভূক্ত যে ২৭টি দেশ রয়েছে তারা প্রত্যেকেই স্বাধীন এবং তাদের নিজস্ব মুদ্রা, ভাষা ও রাজধানী রয়েছে। কিন্তু ভিসা নীতির ক্ষেত্রে তারা অভিন্ন নীতি মেনে চলে- যা হলে শেনজেন ভিসা। শেনজেন ভিসানীতিভূক্ত যে ২৭টি দেশ রয়েছে সেগুলো হলো: জার্মানী, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালী. স্পেন, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, লুক্সেমবুর্গ, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, গ্রীস, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, আইসল্যান্ড, হাংগেরি, স্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ড, মাল্টা লিচেনস্টাইন নেদারল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়া।
দাপ্তরিক কারণে ২০০৮-২০১১ সালে আমার অবস্থান ছিল বেলজিয়ামে ব্রাসেলস দূতাবাসে । এর কাছের দেশ হলো লুক্সেমবুর্গ। ব্রাসেলস মিশন থেকেই লুক্সেমবুর্গের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিষয়াদি দেখাশুনা করা হতো। তাছাড়া সেখানে বসবসরত (খুবই অল্প সংখ্যক) বাংলাদেশিদের কনস্যুলার সেবা ব্রাসেলস মিশন হতেই দেয়া হতো। ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এর সদর দপ্তর লুক্সেমবুর্গ হওয়ায় এটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লুক্সেমবুর্গ চেম্বার অব কমার্স থেকে একটি সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে মান্যবর রাষ্ট্রদূত এর অনুমতি নিয়ে সেখানে যাবো বলে মনস্থ করলাম। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকেও বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়াদির সাথে সম্পর্কিত কর্মকর্তার সাথে মিটিং ঠিক করলাম।
বাংলাদেশ দূতাবাসের বাণিজ্যিক উইং এর বেলজিক গাড়ি চালককে নিয়ে রওয়ানা হলাম সকাল ৬ টার দিকে। প্রায় ৩ ঘন্টার জার্নি শেষে পৌঁছে গেলাম ছোট, ছিমছাম, গুছানো লুক্সেমবুর্গ সিটিতে। সরাসরি চলে গেলাম লুক্সেমবার্গ চেম্বার অব কমার্স এর সেমিনার কক্ষে। সেমিনার শেষ করে লাঞ্চ সেরে নিলাম। পরবর্তী মিটিং এর ফাঁকে এক ঘন্টার মতো সময় পেলাম। এই সুযোগে শহরটা একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। ’ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’-সেই নীতি কথার মতো আমিও লুক্সেমবুর্গ সিটির দু’ একটা তৈরী পোষাকের দোকানে ঢুঁ মারলাম। সারি সারি সাজানো শার্টের কলারে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ দেখে মনে মনে খুব গর্ব বোধ করলাম। স্যালুট জানালাম সেই নাম না জানা গার্মেন্ট্স কর্মীদের, যাদের হাতের ছোয়ায় এ পোষাক তৈরী হয়েছে। ঘড়ি ধরে নির্ধারিত সময়মতো ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের পূর্ব নির্ধারিত সভা কক্ষে হাজির হয়ে প্রাসংগিক আলোচনা সেরে নিলাম। যখন শেষ করলাম তখন ঘড়িতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে গেছে। বেলজিক গাড়ি চালকের সাথে পরামর্শ করে ব্রাসেলস ফেরার পথে ঢুঁ মারতে গেলাম ঐতিহাসিক শেনজেন চুক্তির সেই জায়গাটিতে। জায়গাটি ছবির মতো গোছানো একটি ছোট পর্যটন স্পটের মতো মনে হলো। একটা বড় সড় কক্ষে ঐতিহাসিক সেই চুক্তির স্বাক্ষরের ইতিহাস, ছবি, স্কিপ্ট সাজানো। সবকিছু এক পলক দেখে নিলাম। পাশেই ছোট্ট একটা লেক। সেই সময় (১৯৮৫ সালে) কে জানতো এই ঐতিহাসিক চুক্তি এমন বিশাল একটি মহাদেশকে এক সূতোয় গেথে ফেলবে। ’শেনজেন’ শব্দটি হয়ে উঠবে দেশে দেশে মৈত্রী বন্ধনের অপুর্ব নাম। স্বপ্ন দেখি একদিন এশিয়াতেও এমনটি হবে। ভিসা বিহীন আমরাও একদেশ থেকে আরেকদেশে ভ্রমণ করতে পারবো। অপেক্ষা সেই দিনের তরে।
মিস্টার দো-ভাষী প্রিয় কোরিয়ান বন্ধু আমার
আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় সিউলে বাংলাদেশ দূতাবাসে বাণিজ্যিক কাউন্সিলর হিসেবে পদায়ন এর পর থেকে বেশি বেশি কোরিয়ান ব্যবসায়ীদের সাথে সাক্ষাৎ করা, তাদের শিল্প কারখানায় ভিজিট করা, কোরিয়ার বিভিন্ন শহরে অবস্থিত বিভিন্ন পণ্য ভিত্তিক, অঞ্চল ভিত্তিক চেম্বার অব কমার্সের অফিসে সভা, সেমিনারে অংশ নেয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কোরিয়ায় কোরিয়ান চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ, কোরিয়ান বাণিজ্যি সংস্থা, কোরিয়ান আমদানিকারক সমিতি, কোরিয়ান উন্নয়ন সংস্থা ইত্যাদি অফিস/সংস্থা/সংগঠনগুলো ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মান্যবর রাষ্ট্রদূতের সাথে পরামর্শ করে আমি এসব চেম্বারে ও কোরিয়ান বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও ব্যবসা অনুষদে বাংলাদেশ বিষয়ক সেমিনার করার উদ্যোগ নেই। আমি খেয়াল করেছি কোরিয়ানরা নিজের ভাষার বাইরে ইংরেজিতে যোগাযোগ করতে বেশ সংকোচ বোধ করে। তাছাড়া এক কোরিয়ান আরেক কোরিয়ানকে সামনে এগিয়ে দেয় এবং তাকে অনুসরন করে নিজেরা পথ চিনে নিতে চায়। আমি কোরিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিক যারা বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত আছেন তাদের সাথেও সংযোগ স্থাপন করার উদ্যোগ নিলাম এবং তাদের মাধ্যমে তাদের পরিচিত কোরিয়ান ব্যবসায়ীদের সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলাম। এমনি এক প্রচেষ্টায় আমি প্রায় ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন ব্যবসায় নিয়োজিত একজন কোরিয়ানকে পেয়ে গেলাম। তিনি কোরিয়ান-ইংরেজি-বাংলা এই তিন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। কথাবার্তায় যেমন চটপটে তেমনি আচার-আচরণে বেশ রুচিশীল ও হাসিখুসি। আমি তাঁর সাথে যোগাযোগ করলাম এবং সিউল এবং সিউলের বাইরে চেম্বারগুলোতে সেমিনার সভা আয়োজনে তার সহযোগিতা চাইলাম। দো-ভাষীর ভূমিকা পালন করা ছাড়াও তাঁকে কি করতে হবে সেটা ভালোভাবে বুঝিয়ে বললাম। সেও আমাকে আনন্দচিত্তে এই কাজে সহায়তা করবে বলে কথা দিল।
আমি এই উদ্যোগটি দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যিক নগরী বুসান থেকে শুরু করলাম বুসান চেম্বার অব কমার্স এর সভা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। আমার কাজ ছিলো বাংলাদেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে কোরিয়ান ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে তথ্য তুলে ধরে তাদের এ সুযোগ নেয়ার আমন্ত্রণ জানানো। আমি ইংরেজিতে বক্তব্য রাখার পর সেই কোরিয়ান প্রিয় বন্ধুটি কোরিয়ান ভাষায় তাদের কাছে মূল বিষয়টা তুলে ধরতো। উপস্থিত ব্যবসায়ীদের চোখ মুখ দেখে বুঝতাম তারা তাঁর কথা বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছে। উপস্থাপনের শেষে তাদের প্রশ্নগুলো তার মাধ্যমে মান্যবর রাষ্ট্রদূত এর কাছে উপস্থাপন করা হতো। তিনি আসলে দুপক্ষের মধ্যে একটি ধরনের সেতু হিসেবে কাজ করতো। সেই কোরিয়ান বন্ধুটি এ কাজের জন্য কখনোই কিছু চাইতো না বরং আমাদের জন্য কিছু করতে পেরে সে নিজেকে ধন্য মনে করতো। আমার কাছে মনে হয়েছে আমরা যদি এ ধরনের বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী বিদেশি বন্ধুদের বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে কাজে লাগাতে পারি তাতে বেশ ভালো ফল আনতে পারি। এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য রাড়ানোর সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
ভালো থেকো প্রিয় করিয়ান বন্ধু আমার।
‘কোলমার সিটি’- জীবন্ত জাদুঘর
আমার ব্রাসেলস বেলজিয়ামে কর্মরত থাকা সময়কালে একবার সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত সুইস উন্নয়ন সংস্থা এর আফিসে একটা মিটিং এ আমন্ত্রণ পেলাম। সভার বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ঠিক করলাম গাড়ি নিয়ে লম্বা এ সফরে যাব। তাহলে পথে পথে ইউরোপের ২/৩ টি শহর দেখার সুযোগ হবে। যাত্রা শুরু করলাম এক শনিবার সকালে। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন তাই রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা ফাঁকা। তিন ঘন্টা জার্নি করে ঢুকে পড়লাম ফ্রান্সের একটা সীমান্তবর্তী শহরে। শহর না বলে বলা যায় গ্রাম। বিস্তীর্ণ জমির পাশে পাশে রাস্তা, কিছু বাদে একসাথে কয়েকটি বাড়ি, ছোটখাটো বাজার, খাবারের দোকান। খিদে পেলে দাঁড়িয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অর্থাৎ (আলুর চিপস জাতীয়) আর সফট ড্রিংস দিয়ে নাস্তা সারলাম।
আবার যাত্রা শুরু করতেই ড্রাইভার সাহেব জানালো সামনেই একটা ছোট্ট অথচ আকর্ষণীয় পর্যটকে ভরা একটা শহর আছে যদিও তার জন্য একটু পথ ঘুরে যেতে হবে। আমি একবাক্যে সেই শহরটা দেখে যেতে চাইলাম। তার নাম কোলমার সিটি শহরে ঢুকে একটা পর্যায়ে এসে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে শহরটা দেখতে থাকলাম। শহরের বাড়ি গুলোর বাইরের দিক প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ বছর আগের স্টাইলে করা। অনেকটা জাদুঘরের মত করে শহরটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ করে মনে হবে যেন টাইম মেশিনের চড়ে আমি ১৫০/ ২০০ বছর আগে ফিরে গেছি। কিছুদূর বাদে বাদে সেই পুরানো শহরের ছবি ঝুলানো আছে যা দেখে বর্তমান শহরকে মিলিয়ে নেয়া যায়। দেখা যাবে শহরটা প্রায় হুবহু একই আছে শুধু শহরের মানুষগুলো বদলে গেছে। একটা ছবিতে দেখলাম একটি বাড়ির সামনে পানির কল থেকে টিপ টিপ করে পানি পড়ছে এবং একটা মুরগি সেখান থেকে পানি খাচ্ছে। ঠিক পাশেই একটা ছবিতেও সেই ১৫০/ ২০০ বছর আগে এ বাড়িও পানির কলের ছবিটা ঝুলানো আছে । বাস্তব চিত্র ও ছবির চিত্র প্রায় একই- মাঝে সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর ।
শহরটা ঘোরার মোহ পেয়ে বসল। মনে হল আমি যেন এই শহরেরই একজন। তবে আমি এ সময়ে নাই ফেলে আসা সেই সময়ের একজন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি চলে আশায় আবার যাত্রা শুরু করলাম। পেছনে ফেলে গেলাম জীবন্ত জাদুঘর - ‘কোলমার সিটি’।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com