গাজা জ্বলছে

।। মনোয়ার হোসেন রতন।।

“গাজা জ্বলছে।”
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়াভ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এই শব্দগুলো লিখেছেন। ভাষা সংক্ষিপ্ত, কিন্তু এর পেছনের ইতিহাস, রক্ত, ধ্বংস আর নিপীড়নের ভার অশেষ। এই শব্দ কেবল আগুন নয়, বরং এক জাতির ওপর অন্য জাতির চালানো শতাব্দীর নিপীড়নের সিলমোহর হয়ে উঠেছে।

এই ‘গাজা জ্বলছে’—শব্দবন্ধের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ইসরায়েলের জাতিগত নিধনের নির্মম পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের প্রকাশ্য স্বীকৃতি
জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত সংস্থা প্রথমবারের মতো বলেছে:

“ইসরায়েল গাজায় জাতিগত নিধন (Genocide) চালাচ্ছে।”

এই ঘোষণাটি শুধু একটি বক্তব্য নয়, এটি মানব ইতিহাসে একটি কলঙ্কচিহ্ন, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মরণে রাখবে।

মানবতা কোথায় দাঁড়িয়ে আজ?

৭৫ বছরের দখলদারিত্ব, নির্বিচার ভূমি দখল, বসতি নির্মাণ, হত্যা, অবরোধ, জল-বিদ্যুৎ-চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ার মতো অপরাধের পরও ইসরায়েল তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে নির্লজ্জের মতো।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার প্রতিশোধ হিসেবে শুরু হওয়া ইসরায়েলি আগ্রাসন ২০২৫ সালেও চলছে, এবং এতে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে—যাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু

জাতিসংঘ বলছে,

“গাজা এখন বাসযোগ্য নয়। এটি মানব বসতির জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ জায়গা।”

তবু বিশ্ব নীরব। ইউরোপ-আমেরিকা আজ ‘মানবাধিকার’-এর মুখোশ খুলে ফেলেছে।

জাতিগত নিধনের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য

জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি বাহিনী যে কায়দায় ইহুদিদের ধ্বংস করেছিল, সেই একই কৌশলে আজ ইসরায়েল একের পর এক ধ্বংস করে চলেছে ফিলিস্তিনিদের।

জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, “Genocide” বলতে বোঝায়—একটি জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিক নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত হত্যা, নিপীড়ন, ও সাংস্কৃতিক ধ্বংস।

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে এই প্রতিটি উপাদানই স্পষ্টভাবে রয়েছে:

  • গণহারে বোমাবর্ষণ
  • হাসপাতাল ও স্কুল লক্ষ্য করে হামলা
  • সাংবাদিক ও চিকিৎসক হত্যা
  • খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ
  • শরণার্থীদের শিবিরে হামলা

এইসব কর্মকাণ্ড জাতিগত নিধনের স্পষ্ট প্রমাণ

ইসরায়েলি দম্ভের রাজনৈতিক চরিত্র

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সেই উক্তি—“গাজা জ্বলছে”—শুধু এক নেতার উন্মত্ত উক্তি নয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় অবস্থানের প্রতিফলন।

তারা মনে করছে, তারা শক্তিধর, তাদের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র, তাই তারা যা খুশি তাই করতে পারে।

কিন্তু ইতিহাস বলে, নির্বিচার শক্তি চিরকাল টিকে থাকে না।

ভিয়েতনামে আমেরিকার পরাজয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ পতন, আফগানিস্তানে সোভিয়েত ও আমেরিকার ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে—মানুষের অধিকার চিরকাল দাবিয়ে রাখা যায় না।

গাজা একটি প্রতিরোধের নাম

ইসরায়েল ভাবছে, গাজাকে ধ্বংস করে দিলে ফিলিস্তিনি জাতির চেতনাও মুছে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গাজা এখন শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি একটি প্রতিরোধের প্রতীক

শিশুদের রক্ত, মায়ের কান্না, ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা মানুষের দৃঢ়তা বিশ্বকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়—ফিলিস্তিনিরা নিঃশেষ হয়নি, বরং তারা এখন আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ।

পশ্চিমা দ্বিচারিতা ও মানবাধিকার প্রহসন

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে ‘মানবতা বিরোধী’ আখ্যা দেওয়া পশ্চিমারা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে অস্বীকৃতি জানায়।

তাদের কাছে মানবতা মানে শুধু যখন তা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার সঙ্গে যায়।

তারা ‘ডেমোক্রেসি’, ‘ফ্রিডম’, ‘রুল অব ল’—এই সব বুলি আওড়ালেও, ফিলিস্তিনে শিশুদের মাথা উড়ে যাওয়া তাদের বিবেককে জাগায় না।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে

ইসরায়েল হয়তো সাময়িক জয় পেতে পারে, কিন্তু ইতিহাস তার বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। ঠিক যেমন ন্যুরেমবার্গে নাৎসিদের বিচার হয়েছিল, একদিন হয়তো জেরুজালেমেও সেই বিচার হবে—একটি জাতিকে ধ্বংস করার অপরাধে।

“গাজা জ্বলছে”—এই বাক্যটি একদিন ইতিহাসের ঘৃণিত অধ্যায় হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে জায়গা করে নেবে।

বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেকের দায়: বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশে আছে, ছিল এবং থাকবে। তবে শুধু কূটনৈতিক বিবৃতি নয়, দরকার আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় কূটনীতির।

বিশ্ব বিবেককে জাগাতে হবে, জনমত তৈরি করতে হবে, এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি একাত্মতা আরও জোরদার করতে হবে।

আজকের দিনে, যখন গাজা জ্বলছে, তখন আমাদের কলমকেও আগুন হতে হবে।
আমাদের লেখায় থাকতে হবে সেই প্রতিবাদের তেজ, যাতে আগামীর প্রজন্ম বুঝতে পারে—এই বর্বরতার যুগেও কিছু মানুষ ছিল, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিল।

গাজা জ্বলছে—এই বাক্য শুধু আগুনের নয়, এটি এক ন্যায়ের দাবি, এটি এক জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম।
এটি ইতিহাসের সেই মুহূর্ত, যেখানে আমরা সবাই পরীক্ষার মুখোমুখি। আমরা কোন পক্ষে দাঁড়াব—মানবতা, না বর্বরতা?

inside post
আরো পড়ুন