মনোয়ার হোসেন রতন।।
মানুষের ইতিহাস শুধু গৌরবের নয়, বরং নির্যাতন, নিপীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের করাল গ্রাসেও পরিপূর্ণ। সময়ের কাঁটায় অনেক রাষ্ট্রনায়ক এসেছেন—কারো হাত ছিল জনগণের আশীর্বাদে পূর্ণ, আবার কেউ এসেছেন ট্যাংক, বন্দুক, রক্ত ও ষড়যন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে। কিন্তু ইতিহাস এক কঠোর শিক্ষক। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করালে দেখা যায়—স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী এবং ফ্যাসিবাদী শাসকেরা যতই ক্ষমতার পাহাড়ে চড়ুক না কেন, শেষ দৃশ্যটা হয়ত সেই পলায়নপর, পরাজিত, এবং লাঞ্ছিত পতনের গল্প।
স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় থাকতে নিজেরাই হন আইন, নিজেরাই হন নীতি। তারা সংবিধানকে পদদলিত করে, জনগণকে পরিহাস করে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যক্তিগত দাসত্বে পরিণত করে। কিন্তু সময় যখন উল্টে যায়, তখন এই 'দেবতা'রাই হয়ে ওঠেন শূন্যতায় ভাসমান আত্মা—যাদের ইতিহাস মনে রাখে অপমানের পরাকাষ্ঠা হিসেবে। আর তখনই প্রশ্ন উঠে: ইতিহাসে কি এই স্বৈরাচাররা 'চট' করে আবারও ফিরে আসতে পেরেছে?
উত্তরটা পেতে হলে তাকাতে হয় ইতিহাসের পাতায়।
উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন, যিনি "উগান্ডার কসাই" নামে কুখ্যাত, ১৯৭৯ সালে তানজানিয়ান বাহিনী ও বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতা হারিয়ে পালিয়ে যান লিবিয়া, পরে ইরাক এবং সৌদি আরবে। সৌদিতে গোপন আশ্রয় পেলেও, তিনি জাল পাসপোর্টে আফ্রিকার Zaire-এ প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন বিদ্রোহ উস্কে দিতে। বিমানবন্দরে ধরা পড়ে ফের সৌদিতে ফেরত আসেন, সেখানেই গুমরে গুমরে মৃত্যুবরণ করেন। উগান্ডার মাটিতে আর কখনও পা রাখতে পারেননি।
ইরানের শেষ রাজা রেজা শাহ পাহলভি, ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের মুখে দেশ থেকে বিতাড়িত হন। তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন মিশর, মরক্কো, বাহামা, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, পানামা—শেষে আবার মিশরেই মৃত্যু ঘটে তার। ফিরে যেতে পারেননি তার নিজ জন্মভূমিতে।
২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান পুনরায় তালেবানের দখলে গেলে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি চারটি গাড়ি ভর্তি ডলার নিয়ে পালিয়ে যান ওমান হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। তার সেই পলায়ন ছিল ‘চট করে পালিয়ে যাওয়ার’ এক কুখ্যাত দৃষ্টান্ত। সেই আফগানিস্তানে তিনি আর প্রবেশ করতে পারেননি।
তিউনিসিয়ার দীর্ঘ ২৩ বছরের স্বৈরশাসক বেন আলী গণবিপ্লবের মুখে সৌদি আরব পালিয়ে যান। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে। জনগণের প্রতিরোধ তাকে চিরতরে মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত করে দেয়।
ফিলিপাইনের একচ্ছত্র শাসক ফার্দিনান্দ মার্কোস গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপে আশ্রয় নেন। সেখানেই শোকে-দুঃখে মৃত্যু ঘটে তার। তার মৃত্যুর পর বহু বছরেও তার শাসনের স্মৃতি জনগণের মনে আতঙ্ক হয়ে বেঁচে থাকে।
পারভেজ মোশাররফ, পাকিস্তানের প্রাক্তন স্বৈরশাসক, রাজনৈতিক চাপ, মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, দুবাই ঘুরে বেড়ান। অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন দুবাইয়ে। আর কখনো পাকিস্তানে স্বাভাবিকভাবে ফিরে যেতে পারেননি।
চিলির স্বৈরশাসক পিনোচে, যিনি লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন, শেষ রক্ষা হয়নি তারও। ১৯৯৮ সালে লন্ডন পুলিশ স্প্যানিশ আদালতের পরোয়ানায় তাকে গ্রেফতার করে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ৩০০ অভিযোগ মাথায় নিয়ে বারবার বিচারের মুখোমুখি হতে হয় তাকে।
বলিভিয়ার ইভো মোরালেস গণআন্দোলনের মুখে মেক্সিকোতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। আজও সেই স্বদেশে তার উপস্থিতি বিতর্কের জন্ম দেয়।
এই সব কাহিনিই বলে দেয়—স্বৈরাচারীরা ক্ষমতা হারালে ‘চট’ করে আর ফিরতে পারেন না। যদি ফেরেনও, তাদের সেই ফেরা হয় ইতিহাসের লজ্জার অধ্যায় হিসেবে। জনগণের হৃদয়ে আর স্থান নেই তাদের জন্য। বরং তাঁরা থাকেন উস্কানিদাতা হিসেবে, বিভ্রান্তি ছড়াতে চায় প্রবাস থেকে, কিন্তু মাটি তাদের গ্রহণ করে না। কারণ ইতিহাস জানে, যারা গণতন্ত্রের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে নিজেদের গদির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে চেয়েছিল, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই স্থান পায়। অতএব, ইতিহাস নিঃসন্দেহে বলে—স্বৈরাচারীরা পালিয়ে বাঁচতে পারে, কিন্তু তারা আর ‘চট’ করে ঢুকে পড়তে পারে না। রাষ্ট্রকে পরিবার বানিয়ে যারা জনগণের শ্বাসরোধ করে, তারা ফিরে আসতে চাইলেও জনগণের চেতনার দেওয়ালে ঠেকে যায়। গণমানুষের হৃদয়ের দরজা আর খোলে না তাদের জন্য। তারা থেকে যায় নির্বাসিত, বিস্মৃত এবং ঘৃণিত এক অধ্যায় হিসেবে।
ইতিহাসের এই রূঢ় সত্য এখনো প্রাসঙ্গিক। আমাদের মনে রাখতে হবে—চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র কিংবা বিদেশি মদদে কেউ ‘চট’ করে আসতে পারে, কিন্তু জনগণের মন জয় করা যায় না। ইতিহাস তাই বলে। ইতিহাস তাই শেখায়।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com