প্রভাষ আমিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিভিত্তিক সংগঠন ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হাফিজুর। বন্ধুরা বলছেন, হাফিজুর মেধাবী ছিলেন, ছিলেন প্রাণচঞ্চল। কিন্তু গত মে মাসে হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে যান তিনি। ১৫ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাড়ি থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। তারপর তার আর কোনো খোঁজ নেই। হাফিজুরকে ফিরে পেতে ফেসবুকে বন্ধু-বান্ধবের হাহাকার ছুঁয়ে তাকে চিনতেন না, এমন অনেকের হৃদয়ও। আট দিন পর তার মরদেহ সনাক্ত করা ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের মরদেহ পাশের ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গেই পড়ে ছিল আটদিন! এমন প্রাণবন্ত এক তরুণের এমন রহস্যজনক মৃত্যু বেদনার্ত করে অনেককেই। কিন্তু হাফিজুরের মৃত্যুর কারণ জানার পর সে বেদনা আরো বেড়েছে। পুলিশের দাবি, হাফিজুর লাইসার্জিক এসিড ডাই-ইথালামাইড (এলএসডি) নামে এক ভয়ঙ্কর মাদক নিয়েছিলেন। আর এই মাদক নিলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। যে কোনো করার মত আসুরিক শক্তি ভর করে তার শরীরে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানাচ্ছে, হাফিজুর ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজেই নিজের গলা কেটে ফেলেন। তারপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে সেখানে তিনি মারা যান।
হাফিজুরের মৃত্যু আমাকে মারাত্মক ধাক্কা দিয়েছে। যতবার হাফিজুরের ছবিটি দেখি, ভয়ে-আতঙ্কে আমি কুকড়ে যাই। হাফিজুর আমার সন্তানের বয়সী। হাফিজুর মরে গিয়ে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কী এক ভয়ঙ্কর সময়ে আমরা বাস করছি। মাদক কোনো নতুন সমস্যা নয়, মাদক নিছক বাংলাদেশের সমস্যাও নয়।
মাদকের বিস্তৃতি বিশ্বজুড়ে, আদিকাল থেকে। অসংখ্য শারীরিক সমস্যা তো আছেই; মাদক মানুষকে অমানুষে পরিণত করে, স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করে, সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়ায়। সাধারণত কৌতূহল থেকে তরুণ প্রজন্ম প্রথম মাদক নেয়। তারপর ধীরে ধীরে সে আসক্ত হয়ে যায়। আর সব ধরনের আসক্তিই বিপদজনক। মাদক ধ্বংস করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে। ধ্বংস করে দেয় মেধাবী তারুণ্যকে। প্রথমে বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে নিলেও পরে যে কোনো ব্যক্তি মাদকের ক্রেতা হতে পারে। আর চড়া দামের কারণে মাদক কেনার জন্য তরুণ প্রজন্ম জড়িয়ে পরে নানা অপরাধে। মাদক কেনার টাকা না পেয়ে ভাংচুর, মারধোর, এমনকি বাবা-মাকে হত্যার ঘটনাও আছে। পরিবারে না পেলে মাদকাসক্ত জড়িয়ে পরে চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, এমনকি হত্যার মত অপরাধে। এই যে এখন দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংএর বিস্তার তার পেছনেও মাদকের ছায়া।
সুস্থ রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা না থাকা, অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, সামাজিক অস্থিরতা, একঘেয়েমি, একাকিত্ব পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, বেকারত্ব- নানাবিধ হতাশার কারণে মানুষ মাদকাসক্ত হতে পারে। তবে এসবই অজুহাত। খলের কখনো ছলের অভাব হয় না। সেই কৌতুকের মত, এক ব্যক্তি খুব একটা মাদক নেন না, শুধু যেদিন বৃষ্টি হয় আর যেদিন বৃষ্টি হয় না; সেদিন নেন। ব্যর্থতা, হতাশা এসব আসলে অজুহাত। অনেক সফল মানুষ, মেধাবী মানুষও মাদকাসক্ত হতে পারেন। কয়েকদিন আগে এক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে এক পুলিশ অফিসারের মৃত্যুর কথা আমরা ভুলে যাইনি। আসলে একবার কেউ মাদকাসক্ত হয়ে গেলে তাকে ফেরানো কঠিন।
একসময় এ অঞ্চলে মাদক হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল গাঁজা। সহজলভ্যতার কারণে মানুষ গাঁজা, ভাং, আফিমেই বুদ হয়ে থাকতো। তবে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে নেশা হিসেবে জনপ্রিয়তা পায় কফের সিরাপ ফেনসিডিল। ভারতের এই সিরাপটি বাংলাদেশে এতটাই জনপ্রিয় হয়, সরবরাহের সুবিধার কারণে ভারতের অধিকাংশ ফেনসিডিল কারখানা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংসের মূল হাতিয়ার ইয়াবা। মূলত মিয়ানমার থেকে আসা এই ট্যাবলেটের বাজার এখন দেশজুড়ে। এছাড়া হেরোইন, কোকেন, প্যাথিডিনও মাদক হিসেবে জনপ্রিয়। হাফিজুরের মৃত্যুর পর সামনে আসে এলএসডির নাম। সাথে শোনা যাচ্ছে আইস, ভায়াগ্রা, বুপ্রেনরফিন, গাঁজার নির্যাসে তৈরি কেকসহ নানা মাদকদ্রব্যের নাম। এছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষ পলিথিন বা গাম পুড়িয়েও নেশা করে।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com