মনোয়ার হোসেন রতন ।।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের রাজপথে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা কেবল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না—এটি ছিল এক জাতির চেতনাগত বিস্ফোরণ, নিপীড়নের কুয়াশা ছিঁড়ে আত্মমর্যাদার সূর্য আহ্বানের এক মহাকাব্য। প্রতিটি মিছিল, প্রতিটি স্লোগান, প্রতিটি রক্তাক্ত মুখ যেন একেকটি জীবন্ত দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইতিহাসের মুখোমুখি। যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেবল রক্ত ও ভয় দেখিয়ে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছে, সেখানে সাধারণ মানুষ, ছাত্র, যুবক, নারী—সবাই মিলে গড়ে তুলেছিল এক সম্মিলিত প্রতিরোধ। “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার!”, “বুক পেতেছি, গুলি কর”—এ সব স্লোগান যেন ছিল না কেবল প্রতিবাদ, ছিল জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা অবিচারের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ চাপা চিৎকারের বিস্ফোরণ। দেয়ালের পোস্টার, কবিতার ছত্র, আর রাজপথের দৃশ্যরূপে প্রকাশ পায় গণতন্ত্রের নতুন শৈল্পিক ভাষা।
এ জাগরণ কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি ছিল এক মানবিক বিপ্লব। যেখানে শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য ও ন্যায়ের প্রশ্ন একাকার হয়ে গেছে শোষণবিরোধী মিছিলের সাথে। এই আন্দোলন নিছক একটি সরকারের পদত্যাগের দাবি নয়, এটি ছিল রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তিতে ন্যায়, সহনশীলতা ও সমানাধিকারের স্থাপনার দাবি।
শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রতিবাদ—একেকটি রক্তিম অধ্যায়। আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ইয়ামিন, আহানাফ, রাফি, আলভী, ওয়াসিম নাফিজ, রুদ্র সেন, রিয়া গোপ,,,—এরা শুধু নাম নয়, এরা একেকটি প্রতীক, একেকটি আগুনমুখো ফুল, যাদের আত্মত্যাগে পবিত্র হয়েছে জনতার মিছিল। তাদের রক্তের ছায়া আজও রাজপথে পড়ে আছে—এক স্মারক যা জাতিকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, স্বাধীনতা প্রতিদিনের লড়াই।
তাঁদের রক্তে লেখা হয়েছে এক নতুন জাতীয় চেতনা—যেখানে ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার আদিবাসী’—সবাই একসাথে উচ্চারণ করেছে মানবিক রাষ্ট্রের দাবি। ধর্ম নয়, জাতীয়তাবাদ নয়—মানবতা ও মর্যাদা হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক স্তম্ভ। এ চেতনার উন্মেষেই নিহিত আছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রূপরেখা।
আর এই আন্দোলনের হৃৎকেন্দ্রে ছিল তরুণ প্রজন্ম—যারা ৫২ দেখেনি, ৭১-এর রণক্ষেত্র জানে না, কিন্তু ২৪-এ নিজের চোখে দেখেছে গণতন্ত্র কীভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়, কীভাবে রাষ্ট্র অপমান করে নাগরিককে, আর কীভাবে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে পাঁজরের ভেতর থেকে। “দফা এক, দাবি এক—শেখ হাসিনার পদত্যাগ” ছিল এক গভীর রাজনৈতিক ভাষ্য—কিন্তু এর ভেতরে ছিল আরেকটি স্তর, যেখানে মানুষ কেবল সরকারের পতন নয়, বরং নিজেদের মুক্তির, স্বাভাবিক জীবনের, নিরাপদ ভবিষ্যতের দাবিতে মুখর হয়ে উঠেছিল।
তবু আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা এক ভয়াবহ শঙ্কার জন্ম দেয়—এ জাতি বারবার ভুলে যেতে জানে, ভুলিয়ে দিতেও ওস্তাদ। যদি এ মহাবিপ্লব, এ রক্তস্নাত চেতনা, এ তরুণদের আত্মবলিদান বিস্মৃত হয়, তবে জাতির ভবিষ্যৎ হবে আরো অন্ধকার। “সুবোধ, কবে হবে ভোর?"“সুবোধ, ভোর হয়ে গেছে”—এই দুই পঙক্তির মধ্যবর্তী সময়ে যদি জাতি ঘুমিয়ে পড়ে, তবে সেই ভোরও পরিণত হবে আরেকটি নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায়।
শেষ পর্যন্ত একটি সত্যই উচ্চারিত হয়—“ভয় পেলে শেষ, রুখে দাঁড়ালেই বাংলাদেশ।”
২০২৪-এর এ রক্তাক্ত জাগরণ কেবল ইতিহাস নয়, এটি একটি চলমান চেতনার বীজ—যার শিকড় সমাজের গভীরে প্রবেশ করছে, এবং যার ফল একদিন হবে এক মানবিক, ন্যায্য, শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশের নির্মাণ। এখন প্রশ্ন, আমরা কি প্রস্তুত সেই বীজকে লালন করার জন্য?
আজ এ আন্দোলন আমাদের সামনে রেখে গেছে একটি ঘোষণা—not just a political manifesto, but a moral proclamation:
“তোরা সব জয়ধ্বনি কর”—এখন আর কেবল স্লোগান নয়, এটি এক নতুন বাংলাদেশের অঙ্গীকার।