মো. মেহেদী হাসান।।
এক.
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থান হয়। যার ফলে ষোল বছর ধরে শাসনে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে কোন প্রেক্ষাপটে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২০২৪এ নির্বাচন হয়। এনির্বাচনের নামকরণ করা হয় 'ডামি নির্বাচন'। বিএনপি, জামাতসহ ছোট ছোট বামদলগুলোও এনির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায়। নজিরহীন আরেকটা নির্বাচন হয়। এর আগে ২০১৮সালে 'রাতের ভোটে' সরকার গঠিত হয়। ২০১৪সালে ১৫৩জন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। অর্থাৎ বিগত তিনটা নির্বাচনে জনমতের কোনো প্রতিফলন ছিল না। বিগত তিনটি সরকার কোনোভাবেই জনগণের সরকার নয়। ২০২৪সালে নির্বাচন ছাড়াও কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। নতুন সরকার গঠিত হবার পর শেখ হাসিনা প্রথমে ভারত সফর করেন। দেশের মাঝখান দিয়ে ভারতের জন্য রেললাইনের সমঝোতা স্মারক ও মংলা বন্দর ভারতকে দেওয়ার বিষয়ে সোশাল মিডিয়ায় জোরদার আলোচনা শুরু হয়। এরপরই শেখ হাসিনা চীনে যান। চীন থেকে সাধারণত বাংলাদেশ অর্থ ঋণ পায়। এ-সফরে এ-জাতীয় প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ পায় নি। বরং শেখ হাসিনা সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে আসেন। দেশে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ডলার সংকট চলছিলো অস্বাভাবিক। একটা চাপা অনুচ্চারিত অস্থিরতা ছিল ভারত সফর ও চীন সফরের ব্যর্থতা নিয়ে। এমন সময়ে কোটা সংক্রান্ত সুপ্ত সমস্যা হাইকোর্টের একটা রায়ে জেগে ওঠে। এ-মামলাটা ঘুমিয়ে ছিল। আমার ধারণা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সামাল দিতে, মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে দিতে এটা সামনে আনা হয়। পচা শামুকে পা কেটে যায় সরকারের। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি শেখ হাসিনার প্রতিকূলে ছিলো। জনগণ ক্ষুব্ধ ছিলো, কিন্তু প্রতিবাদের কোনো পথ পাচ্ছিল না। ২০২৩সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ছিলো। রাস্তায় মানুষও নেমেছিলো। ৩টার সভা পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেডের ভয়ে ১টার দিকে প- ঘোষণা করে বিএনপি মঞ্চ ছেড়ে দেয়। মানুষের হাতে দলীয় নেতৃত্বে সরকারকে সরানোর আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। মানুষ তরুণ ছাত্রদের ক্ষোভ আর বেকারত্বের বেদনার সঙ্গী হয়। সরকারের পতন ঘটে। সরকার প্রধান ভারতে আশ্রয় নেন। এ-ভারতই ছিলো শেষ পতিত সরকারের একমাত্র মিত্র। এটাও মানুষ ভালোভাবে নেয় নি।
দুই.
একটা অবরুদ্ধ সমাজ হঠাৎ মুক্তির আনন্দ পেলে যা হয়, অনেকটা দিশাহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অবস্থা হয়েছে এমনই। দেশে কোনো একক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান না হওয়ায় দলগুলো যার যার এজেন্ডায় ফিরে যায়। আবার অনৈক্য বিভেদ দেখা দেয়।
শেখ হাসিনার পলায়নের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম কাজ হয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এটা প্রথাগত 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' হিসেবে নয়, বরং 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার' হিসেবে অভিহিত হয়। এ-সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ করা এবং বিগত সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার নিশ্চিত করা। অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকার বেশ কিছু জরুরি উদ্যোগ নেয়। আইএমএফের মতে, দেশের ব্যাংকিং খাতের ৮০% তহবিল লুট হয়েছিলো বিগত সরকারের আমলে। অন্তর্র্ব্তীকালীন সরকারের গঠিত টাস্কফোর্স বলেছে ২৩৪বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের সম্পদ পাচার হয়েছে। এসময়ে এতো বড় বিপর্যয় থেকে উঠে আসা সহজ ছিল না। সরকার গত এক বছরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আংশিক সাফল্য পেয়েছে। দ্রব্যমূল্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমেছে। অবস্থা আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধার করা সম্ভব না হলে আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। তার দুএকটা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে, প্রবাসীদের ব্যাংকিং ব্যবসথায় অর্থ পাঠানো বেড়েছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত বেশ কিছু বৈরি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জবাবে বাংলাদেশ প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে কম। এটা খুবই ইতিবাচক।
নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনের পথ প্রশ^স্ত করার চেষ্টা চলছে। বিগত সরকারের আমলের কিছু বড় দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়েছে এবং কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটি জনগণের মধ্যে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে যে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। বিচার বিভাগের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে, যা দীর্ঘকাল ধরে একটি বড় অভিযোগ ছিল। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেক বিতর্কিত সংবাদমাধ্যমকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো দমনমূলক আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে হয়রানি কমেছে এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনার সুযোগ বেড়েছে। যা একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য অপরিহার্য।
তিন.
দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়েছে, তবে বড় মাপের দুর্নীতিবাজদের দ্রুত বিচার এবং তাদের সম্পদের পুনরুদ্ধার এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় হতাশা রয়েছে।
বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এবং অভ্যন্তরীণ কিছু কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে দেশের অর্থনীতি এখনও পুরোপুরি স্থিতিশীল হতে পারেনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান বয়ান ছিলো তরুণ সমাজের কাজের অধিকার। এক্ষেত্রে সরকার চেষ্টা করলেও অগ্রগতি নেই বললেই চলে। সরকারের গেজেটে নিহতদের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ৩৫% শ্রমজীবী, ৩৩% ছাত্র, ১৫% ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং ১৩% বেসরকারি চাকরিজীবী। এ-থেকে বোঝা যাচ্ছে, অভ্যুত্থানের মূল কারণ অর্থনৈতিক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কর্মহীনতা আর অর্থনীতির মূল সংকটে মনোযোগ না দিয়ে জাতীয়তা, ধর্ম, রাজনীতি এসব সামনে এনে বিভেদ এবং কোলাহল চলছে।
তিন.
বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা কমেছে। তবে স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ করে, অতীতের রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। পুলিশ এখনো দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারে নি। ফলে দেশে অপরাধ বেড়েছে। রাজনৈতিক হিংসা প্রতিহিংসা দেখা দিয়েছে। নির্বাচন ঘোষিত হলে এটা আরও বাড়বে। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, দেশে দক্ষিণপন্থী উত্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা বাস্তবতা। এর কারণ আমরা সবাই জানি, মুক্তিযুদ্ধের বয়ান ছিলো সম্পদের পাচার রোধ ও সুষম বন্টন। গত পনের বছরে মুক্তিযুদ্ধের নামে সম্পদ পাচার ও লুণ্ঠন হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ বিকল্পে আশ্রয় নেয়। দেশে বাস্তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামপন্থী রাজনীতি বাইনারি রূপ নিয়েছে। দুটোই মৌলবাদ। একটা অন্যটা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে পুষ্ট হয়। এর হাত থেকে বাঁচতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। সে রকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
চার.
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা এই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন না আসায় কিছু মহলে অসন্তোষ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। একটা বাস্তবতা হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমিত ম্যান্ডেট রয়েছে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদী নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীগণ নানা মত পথে বিভক্ত। চরম দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী, পাহাড়ি, নারী, বামপন্থী, গণতান্ত্রিক শক্তি— সকলে মিলে ইনক্লুসিভনেসের ধারণায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামে। শেখ হাসিনার পলায়নের পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে যে যার এজেন্ডায় ফিরে গেছে। ফলে দেশে এতো রক্ত, আত্মত্যাগের পর সংস্কার ও গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনা কমে গেছে। আমরা হয়তো ভবিষ্যতে আরও গণঅভ্যুত্থান দেখতে পাবো। আপাতত মোটাদাগে নির্বাচনি সরকারের অপেক্ষায় মানুষ।
পরিশেষে বলা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। শেখ হাসিনার পলায়ন এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগমন জনগণের ক্ষমতায়নকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। গত এক বছরে এই সরকার একদিকে যেমন জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে কিছু কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখিও হয়েছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। এই সরকার যদি জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে পারে, তবেই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের শহীদদের ঋণ কিছুটা শোধ হতে পারে।
লেখক: উপাধ্যক্ষ,কিশোরগঞ্জ গুরু দয়াল সরকারি কলেজ।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com