বাহার উদ্দিন খান।।
২০২৪ সালের জুলাই মাস। বছরের আর দশটা জুলাইয়ের মতো নয়- এই জুলাই যেন ইতিহাসের গায়ে নিজের নাম খোদাই করে ফেলল। আবহাওয়ার তাপমাত্রা যেমন ছিল অস্বাভাবিক, তেমনি উত্তপ্ত ছিল রাজপথ, চেতনা আর মানুষের বুকের ভিতর জমে থাকা ক্ষোভ।
চারদিকে শ্লোগান “এক দফা, এক দাবি”, “ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক”, “ছাত্র জনতার সংগ্রাম চলছে, চলবে।”
ছাত্র জনতার এই অভ্যুত্থানকে কেউ বলেন এটা “জুলাই গণঅভ্যুত্থান”, কেউ বললেন “দ্বিতীয় স্বাধীনতা”, কেউবা “নতুন গণজাগরণ”। কিন্তু আমি বলি এটা ছিল পুনর্জন্ম। একটি দেশের, একটি জাতির, একটি আত্মপরিচয়ের।
সামাজিক গণচেতনার উত্থান
[caption id="attachment_41802" align="alignleft" width="300"] লেখক[/caption]
এই আন্দোলনের পেছনে ছিল মানুষের দীর্ঘদিনের জমে থাকা সামাজিক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। দুর্নীতি, নিরাপত্তাহীনতা, বাকস্বাধীনতার সংকোচন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি সব মিলিয়ে নাগরিকরা যে গভীর বঞ্চনার মধ্যে বসবাস করছিল, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল তারই সমবেত ও শৃঙ্খলিত বিস্ফোরণ।
শুধু শহরেই নয়, দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক নতুন ধরনের গণসংযোগের উদাহরণ সৃষ্টি করে। ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক যারাই সচেতন নাগরিক, তারা নিজ নিজ প্ল্যাটফর্ম থেকে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের কাছে।
নেতা নয়, চেতনা-নির্ভর এক বিপ্লব
আমরা যখনই কোনো আন্দোলনের কথা শুনি, তখন আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে আগুনে পোড়া গাড়ি, ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি, পুলিশের টিয়ার শেল, রক্তে ভেজা রাজপথ, কিংবা এক ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া শহরের ছবি। আন্দোলন মানেই যেন নৈরাজ্য, আতঙ্ক, কিংবা স্রেফ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ২০২৪ সালের এই জুলাই ভিন্ন ছিল। এই জুলাই ছিল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা,অন্যরকম এক গল্প, যা কেবল ক্ষোভের নয়, বরং চেতনার, সৌন্দর্যের, সহানুভূতির এবং দায়িত্বশীলতার এক নবতর অধ্যায়।
রাজপথে নামা মানুষের চোখে মুখে ছিল আলাদা দীপ্তি, একটি ভালো দেশের স্বপ্ন, একটি ভালো সমাজের খোঁজ। কেউ ক্ষুব্ধ, কেউ কাঁদছে, কেউ সাহস জোগাচ্ছে অন্যকে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল এই আন্দোলনের নেতৃত্ব। ছাত্ররা সামনের সারিতে থাকলেও এটি ছিল সম্পূর্ণ বিভাজনহীন এক নেতৃত্ব। এখানে ছিল না কোনো রাজনৈতিক দলের ছায়া, ছিল না কোনো দলীয় নেতার নির্দেশ, কিংবা লাঠিবাজ কর্মীদের শোডাউন।
জনতার গণজাগরণ
এই অভ্যুত্থানে ছিল ছাত্র, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী, শিল্পী, উদ্যোক্তা, আপামর জনতা যারা প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে জেগে উঠেছে। অনেকে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, চোখেমুখে ছিল সমর্থন, ছিল সহমর্মিতা। এই জায়গাটাই ছিল সবচেয়ে আবেগময়।
এই অভ্যুত্থান দেখিয়েছে, আন্দোলনের শক্তি শুধু শ্লোগানে নয়, বরং নির্ভর করে জনতার সম্মিলিত আত্মবোধ ও ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাসের ওপর। আর সেই গভীর মানবিক সংযোগ যেখানে একে অপরের যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়া যায় সেটাই ছিল সবচেয়ে আবেগময় এবং গর্ব করার মতো অংশ।
সাংস্কৃতিক প্রতিফলন: দেয়াললিখন, কবিতা আর গানের ভাষা
জুলাইয়ের অভ্যুত্থান ছিল কেবল রাজপথের না, এটি ছিল মনের, ভাষার, আর শিল্পের বিপ্লবও। ছাত্রদের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে কবিতা, গানের লাইন, দেয়াল লিখনের প্রতিচ্ছবি। ঢাকার অলি গলির দেয়ালগুলোতে ছিল প্রতিবাদের ভাষা“আমরাই গড়ব নতুন বাংলাদেশ”, “বুক পেতেছি গুলি কর” কিংবা “পানি লাগবে পানি’
নাট্যদল, গণসঙ্গীত শিল্পীরাও পথে নেমে এসেছিল, প্রতিবাদের সুরে ভরিয়ে দিয়েছে জনতার মিছিল। এই সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ আন্দোলনকে দিয়েছে এক অতল গভীরতা, দিয়েছে সম্মিলিত কণ্ঠস্বরের জোর।
গণআন্দোলনের ফলাফল নতুন শুরুর বার্তা
৫ আগস্ট, ২০২৪।
আন্দোলনের চূড়ান্ত ফল আসে জনতার ঐতিহাসিক রায়ের মধ্য দিয়ে, জনআকাংখার মধ্য দিয়ে। সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বলা হয়, এটি ছিল জনতার জয়। কিন্তু আমি বলি, এটি ছিল বিবেকের জাগরণ।
মানুষ শিখেছে,আন্দোলন মানে শুধু আগুন নয়, তা আলোও ছড়াতে পারে।
শিক্ষার্থীরা শিখেছে নেতৃত্ব দিতে, কর্মজীবীরা শিখেছে জবাব চাইতে, নারীরা শিখেছে শহরের নিরাপদ পথের দাবি তুলতে। এই অভ্যুত্থান আমাদের নতুন এক চেতনাকে জন্ম দিয়েছে,যা ভবিষ্যতের বাংলাদেশে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু করেছে।
শেষ কথায় কিছু অনুরোধ
জুলাইয়ের প্রতিটি সন্ধ্যা, প্রতিটি বৃষ্টিভেজা সকাল, রোদে ঝলসানো দুপুর যেখানে মানুষ অপরিচিতের মুখে সাহস খুঁজেছে, স্নেহ পেয়েছে, চোখের জল ভাগ করে নিয়েছে- এই স্মৃতি যেন আমরা ভুলে না যাই। এই অভ্যুত্থান কেবল একটি ঘটনা নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক-বিবেকি বিপ্লব।
আগস্টের এই দিনে আমি যখন পেছনে তাকাই, তখন সেই গর্জে ওঠা রাজপথের স্মৃতি এখনো কানে বাজে। আমি জানি, ইতিহাস চুপচাপ থাকে না। আর এই ইতিহাস লিখে গেছে সাধারণ মানুষের সাহসের গল্প।
আমাদের এখন দায়িত্ব এই স্বাধীনতা, এই অর্জন, এই গণচেতনা রক্ষা করা। কারণ, স্বাধীনতা শুধু পাওয়া নয় রক্ষা করাটাই বড় লড়াই।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com