জুলাই ৩৬’র অভ্যুত্থান ছিল ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস

মোঃ রফিকুল ইসলাম সোহেল ।।
৩৬ ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ নিপিড়িত জনতার শক্তি।
২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থান ছিল ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস।
“আমরা জুলাই বিক্রি করি না বন্ধু
কেউ কি বলো তো নিজেকে বিক্রি করে।
আমরা সবাই এখানে জুলাই বন্ধু। আমরা জুলাই ভুলতে দেবনা বন্ধু।
আমরা জুলাই-এ আজো নেই নিঃশ্বাস।
বুকের ভেতরে আনাসের লেখা চিঠি।
আমরা সবাই এখানে জুলাই বন্ধু। জুলাই রয়েছে এ মাটির অন্তরে আমরা জুলাই ভুলতে দেবো না বন্ধু। রাস্তায় পড়েছিল ইয়ামিনের লাশ। আমরা জুলাই ভুলতে দেবো না বন্ধু। জুলাই আমার আবু সাঈদের জান। চির-অমলিন আমার এ বাংলাদেশ। অনন্তকাল থাক সিনা টানটান। আমরা জুলাই ভুলতে দেবো না বন্ধু। মুগ্ধর হাতে বিনা পয়সার জল। কত বাবা-মা’র ফারহান ফাইয়াজ। কত বাবা মার ছিল শেষ সম্বল …সংগীত শিল্পী সায়ানের গাওয়া একটি গানের কিছু অংশ। আমি জুলাই-এর গল্প বলবো বন্ধু’ গানটি সায়ান উৎসর্গ করেছেন গোটা পৃথিবীর আন্দোলন-সংগ্রামরত সকল লড়াকু প্রাণকে, যারা আস্থা রাখেন মানুষের প্রতিরোধের শক্তিতে”।
এই গানের প্রতিটি লাইনে ছড়িয়ে আছে জুলাইয়ের আবেগ ও অনুভূতি। “আমরা” শব্দটির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ শক্তির কথা বলা হয়েছে।
জনবিচ্ছিন্ন ও দুর্নীতিগ্রস্থ আওয়ামী সরকারের পতনের এক বছর এখনো পূর্ণ হয়নি। কিন্তু আমরা জুলাইকে ভুলতে বসেছি। যে ঐক্যের ভিত্তিতে ক্ষমতালোভী ও ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে চলমান বেপরোয়া, নির্মম, গুম,খুন, লুট ও নির্লজ্জ্বভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘাড়ে দৈত্যের মত চেপে বসা এক ঘৃণ্য
স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক দল ও শ্রেণি, পেশার মানুষ আন্দোলন করেছিলেন, সেই ঐক্য আর এখন দেখা যাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “গত বছরের জুলাইয়ে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেখানে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের ৮০ ভাগ ছিল শ্রমজীবী মানুষ আর ২০ ভাগ উচ্চ শ্রেণির মানুষ। যে ৮০ ভাগ শ্রমজীবী মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, তারা কিন্তু আন্দোলনের পর ঘরে ফিরে গেছেন। এখন সেই ঐক্য নিয়ে যারা দেন দরবার করছেন। তারা উচ্চ শ্রেণির। এখানে তাদের স্বার্থের সংঘাত আছে। ফলে তারা কখনো একত্রিত হতে পারবে না। কারণ, তাদের স্বার্থ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। ফলে, যেটা ঘটার ছিল, সেটাই ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।
দিলারা জামানের সাথে পুরোপুরি একমত না হলেও কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। বিভিন্ন সংবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় কিভাবে এক শ্রেনীর মানুষ রাজনীতিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে রাজনীতির গুণগত মানকে ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন, রোডস এন্ড হাইওয়ে, এলজিআরডি সহ সরকারের অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে জড়িত এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর শত কোটি টাকার ঠিকাদারির টেন্ডারবাজি, সকল স্তরের চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিন্তু বন্ধ না হয়ে বরং ৫ ই আগস্টের পর এসব কিছুতেই শুধু হাত বদল হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হস্তান্তরের পরিবর্তে তাদের অপরাধ প্রমাণ করার সুযোগ না দিয়ে নানাভাবে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে কেউ কেউ।
৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ এ সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় অভ্যুত্থান, অভ্যুত্থান পরবর্তী সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে একজন অতি সাধারণ নাগরিক হিসেবে যে স্বপ্ন নিয়ে লিখেছিলাম বা
মনের ভাবনা প্রকাশ করেছিলাম তা অনেকটা ম্লান হতে দেখে মোটেও বিস্মিত হচ্ছি না।
বাবার কাছে থেকে ৭১ এর গল্প শুনেছি, বড় হয়ে মানচিত্র এবং পতাকার সাথে পরিচিত হয়েছি। চেষ্টা করেছি অর্জিত মানচিত্র ও পতাকার সম্মান রক্ষা করতে।
৯০ এ স্বৈরাচার পতনের সাথে যুক্ত ছিলাম। জুলাই ৩৬ হুইল চেয়ারে বসেই বিজয়ের প্রত্যাশা করেছিলাম। মানচিত্র ও পতাকা প্রাপ্তির পর আমরা কেউই ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে সরকার গঠন করা হয়। নতুন এই সরকারে উপদেষ্টা মোট ২৪ জন, যাদের মধ্যে তিনজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। (পরবর্তীতে একজন ছাত্র সমন্বয়ক পদত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন।)
গঠিত উপদেষ্টা পরিষদকে দেখে আশান্বিত হতে পারিনি। যতই দিন গড়িয়েছে আমরা দেখতে পেয়েছি ড. মোহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্বলতম সরকারের পরিণত হয়েছে। সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী সকল মহল তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে রাজপথ থেকে সচিবালয় সর্বত্র একটি বিশৃংখল অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সাধারণ জনগণ গণভবনে প্রবেশ করে কিন্তু বের হওয়ার সময় কারো হাতে শাড়ি কারো হাতে নানান আসবাব দেখা গেছে। সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে জাতি হিসেবে আমাদেরকে আরো সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুছ উপদেষ্টা মাহফুজকে মাস্টার মাইন্ড হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে। এই ইঙ্গিত নানা জনে নানা মতের সৃষ্টি হয়েছে।
তারপর থেকেই শুরু হয় আন্দোলনে একক মাস্টার মাইন্ড সূত্র। সর্বশেষ গত ১৯ শে জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমীর ডাঃ শফিকুর রহমানকে মাস্টার মাইন্ড হিসাবে পরিচয় করে দেওয়া হয়। আমি মনে করি এই ধরনের ভূমিকা একটি সফল ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থান পরবর্তী নানা বিষয়ে ঐক্যের বিষয়ে মতপার্থক্যের সৃষ্টি করে।
২৮ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ছাত্র নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল হিসাব জাতীয় নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করে। এতে যুক্ত আছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনার জন্য প্রয়োজন অর্থ অভিজ্ঞতা ও জনসম্পৃক্ততা। যেহেতু নেতৃত্বে ছাত্ররা জনসম্পৃক্ততা ছাড়া বাকি দুটি বিষয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে এবং উঠেছেও। সময়ের পরিক্রমায় হয়তো অভিজ্ঞতা অর্জিত হবে কিন্তু অর্থের উৎস কি হবে!
আমি মনে করি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের যে পরিমাণ গ্রহণ যোগ্যতা তৈরি হয়েছিল এর মাধ্যমে তারা দেশের সর্বস্তরে বিদ্যমান বৈষম্য সমূহ দূর করার বিষয়ে মডারেটরের ভূমিকা পালন করলে দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পেত। বৈষম্য দূরীকরণ দৃশ্যত এখন যত গতিতে চলছে বাস্তবে এ গতি হয়তো আরো দ্বিগুণ হতে পারতো।
এ প্রসঙ্গে বলতে পারি জুলাই অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচার, শহীদ পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, আহতদের পুনর্বাসনের কাজগুলো যে গতিতে হওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না।
গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন সুশাসন ও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা দেওয়া হলেও সুনির্দিষ্ট রোড ম্যাপ এখনো পরিষ্কার নয়। সুশাসনের প্রক্রিয়াটিতে সকলকে একই প্লাটফর্মে আনতে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে।
ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম নিচ্ছে। সেই অবিশ্বাস থেকেই ঐক্যে ফাটল ধরছে।
সরকার চাইলে এখনো সেটা ফিরিয়ে আনতে পারে।” সেইসাথে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই এই “দূষিত বাক্যটিকে” মাটি চাপা দেওয়া যায় কিনা এই বিষয়টিও ভাবতে হবে।
জুলাই ৩৬ বাংলাদেশের রাজনীতি গুণগতমান পরিবর্তনের একটি দারুণ সুযোগ। আমি মনে করি সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। পরবর্তীতে আর কোন ৯০ কিংবা জুলাই ৩৬ দেখতে না চাইলে এখন থেকে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ ও দেশের আগামী প্রজন্মের জন্য সুদৃঢ বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। আপনাদের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
সায়ানের কবিতায় শেষ করছি
লাশের পাহাড় রাখা ছিল উঁচু করে। ক্ষমা করবো না বিশ্বাসতকতা সব জেনে যারা জুলাই বিক্রি করে।
এ মাটির নাম এখনো “বাংলাদেশ” /কেননা আমরা এখনো “বাংলাদেশ” কেননা এখনো মরেনি বাংলাদেশ।
—
লেখক: সমাজকর্মী ও হুইলচেয়ার সারভাইভর।
