কুবি প্রতিনিধি।।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকতে পারবেন না। তবে সেই নির্দেশনা লঙ্গন করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি জালিয়াতি করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাসহ লাভজনক নানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন সহকারী রেজিস্ট্রারের বিল্লদ্ধে। ওই কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি প্রকল্পের অভিজ্ঞতা সনদ দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে জাল করে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে দরপত্র জমা দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দু'টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাকির হোসেনের স্ত্রী ও স্বজনদের নামে হলেও তিনি নিজেই এসব পরিচালনা করেন বলে জানা গিয়েছে। নিজের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ পেতে প্রকৌশল দপ্তরের কোনো কর্মকর্তার সহায়তায় তিনি এসব নথি জালিয়াতি করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের অধীন নাঙ্গলকোট উপজেলার একটি ঘুর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পেতে মের্সাস ল্যান্ডমার্ক বিল্ডার্স, মের্সাস এইচ কবির এন্টারপ্রাইজ নামের দু'টি প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা সনদসহ দরপত্র জমা দেয়। এ তিনিটি প্রকল্পের ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ল্যান্ডমার্ক বিল্ডার্স জাকির হোসেনের স্ত্রী এবং এইচ কবির এন্টারপ্রাইজ তার পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে বলে জানা যায়। অথচ এসব প্রকল্পের কোনটির কাজই এই দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করেনি বলে নিশ্চিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর।
গেল বছরের ২৬ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরে মেসার্স ল্যান্ডমার্ক বিল্ডার্স ও মেসার্স এইচ কবিত এন্টারপ্রাইজের অভিজ্ঞতার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য চিঠি পাঠায় সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। চিঠির উত্তরে ৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: এস.এম. শহিদুল হাসান স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদনে ‘যাচাইকৃত এবং সঠিক নহে’ উল্লেখ করে দাপ্তরিক মেইল থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে মেইল পাঠানো হয়। তবে ১২ সেপ্টেম্বর পুণরায় দাপ্তরিক ডোমেইনযুক্ত মেইল থেকে একই ব্যাক্তি স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে ‘যাচাইকৃত এবং সঠিক আছে’ উল্লেখ করে আরেকটি মেইল পাঠানো হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একই বিষয়ে দুই রকম মতামত দেয়ায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালক এস এম এনামুল কবির স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে ফের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অনুরোধ করা হয়। এতে এ জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে এমন জালিয়াতির ঘটনায় প্রশাসনকে কোনো অভিযোগ করেনি প্রকৌশল দপ্তর। অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো জাকির হোসেন পরিচালনা করায় তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের কোনো অসাধু কর্মকর্তার সাহায্যে এমন জাল কাগজ তৈরি করেছেন ও দাপ্তরিক মেইল ব্যবহার করে তিনি নিজেই সরকারি দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।
অভিযুক্ত কর্মকর্তা জাকির হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে কর্মরত থাকলেও তার বিল্লদ্ধে ঠিকাদারী ব্যবসা, ল্যান্ডর্মাক পলিটেকনিক ইনিষ্টিটিউট, ল্যান্ডমার্ক প্যারা মেডিক্যাল ইন্সিটিউটসহ একাধিক লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশ না করার শতে রেজিস্ট্রার দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, জাকির হোসেন সবসময় ঠিকাদারী কাজে ব্যস্ত থাকেন, নিয়মিত অফিসও করেন না। কেউ কিছু বললেই তিনি অশোভন আচরণ করেন। এরআগে সে একজন শিক্ষক ও এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে অশোভন আচরণ করেন।
নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রকৌশলী বলেন, তার সাথে প্রকৌশল দপ্তরের অনেকেরই সখ্যতা রয়েছে। তিনিই সেই দপ্তরের কারও সহযোগিতায় এসব জালিয়াতি করেছেন। এই বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই দাপ্তরিক মেইল হতে দুইরকমের প্রতিবেদন যাওয়ার বিষয়টি জানার পরও সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হয়নি।
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: এস. এম. শহিদুল হাসান বলেন, আমার স্বাক্ষর জাল করে এগুলো প্রেরণ করা হয়েছে। যাচাইয়ের জন্য আসলে সঠিক নয় মর্মে প্রতিবেদন দিয়েছিলাম আমি।
দাপ্তরিক ডোমেইনযুক্ত মেইল হতে দু'বার ভিন্ন দুটি প্রতিবেদন প্রেরণের বিষয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, অনেকসময় আমরা পিয়নকে পাঠাইতে বলি ওইখানে কিছু হয়েছে কিনা। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানান, প্রশাসনকে এ বিষয়ে কিছু জানাই নাই, কারণ এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।
এসকল জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, আমি এ বিষয়ে জানি না, আপনার কাছ থেকে শুনলাম। ল্যান্ডমার্কস বিল্ডার্স ওনার স্বজনের নামে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পারিবারিক ব্যবসা হতেই পারে। পরিবারের কারও ব্যবসা থাকলে তো আমার কিছু বলার নাই। ল্যান্ডমার্কের সাথে আমার সম্পৃক্ততা আমার থাকলেই কী আর না থাকলেই কী। পরিবারের কাজ থাকলে আমার দরদ থাকবেই। তবে ল্যান্ডর্মাক পলিটেকনিকসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমার, আমি এগুলো পরিচালনা করি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ.এফ.এম. আবদুল মঈন বলেন, অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে কেউ জড়িত হলে তার বিল্লদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়াও, ২০১৪ সালে জাকির হোসেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষকের সাথে অসদাচরণ করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে তৎকালীন শিক্ষক সমিতি সপ্তাহব্যাপি আন্দোলন করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আরও একাধিক কর্মকর্তা-সাংবাদিককেও লাঞ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে এ কর্মকর্তার বিল্লদ্ধে। এঘটনাগুলোতে বিভিন্ন সময় তদন্ত কমিটি গঠন হলেও এ কর্মকর্তা রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com