মনোয়ার হোসেন রতন।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের আত্মা ও মেরুদণ্ড। এখানকার ডাকসু নির্বাচন সবসময়ই জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম কিংবা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই—সব ক্ষেত্রেই ডাকসু নেতৃত্ব দিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন এক অনন্য বার্তা দিয়েছে—শিক্ষার্থীদের রায় এখন আর অন্ধ আনুগত্যে নয়, বরং বিশ্লেষণ, বিকল্প খোঁজা ও বিশ্বাসযোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত।
শিবিরের অপ্রত্যাশিত ভোট: বিতর্কের আগুন
নির্বাচনের পর সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন—এক সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত ও বিতর্কিত সংগঠন শিবির কীভাবে এত ভোট পেল? ঢাবির মতো ঐতিহ্যবাহী ক্যাম্পাসে এ ফলাফল শুধু বিস্ময়কর নয়, জাতীয় রাজনীতির জন্যও এক সতর্ক সংকেত।
ডা. জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ রুমির মন্তব্য—
“শিবির কেন এত ভোট পেল, সেটা বাদ দিন। আপনারা কেন এত কম ভোট পেলেন সেটা ভাবুন।”
এই বক্তব্য পুরো বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে। মূল সমস্যা হলো—প্রচলিত ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিবিরকে সমর্থন করেছে কি না, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো—ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী সংগঠনগুলো কেন আস্থার বাইরে চলে গেল?
প্রচলিত ছাত্র সংগঠনের ব্যর্থতা
ডাকসু নির্বাচন স্পষ্ট করেছে—শিক্ষার্থীরা আর চোখ বুজে ভোট দেয় না। তারা দেখছে—
এই চর্চা সংগঠনগুলোর ভাবমূর্তি ধ্বংস করেছে এবং শিক্ষার্থীদের মনে তীব্র বিরক্তি ও অবিশ্বাস তৈরি করেছে। তাই তারা বিকল্প খুঁজছে, প্রমাণ করছে—“অন্ধ আনুগত্য নয়, যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতেই নেতৃত্ব টিকে থাকে।”
শিক্ষার্থীদের সচেতনতা: মিডিয়ার প্রভাব
আজকের শিক্ষার্থীরা শুধু ক্যাম্পাস পোস্টার বা স্লোগানে আটকে নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনই তাদের প্রতিদিনের তথ্যের উৎস। তারা জানে কোন নেতা কোথায় দাঁড়ায়, কারা জাতীয় রাজনীতিতে কী ভূমিকা রাখছে।
ডা. রুমির ভাষায়:
“ঢাবির মেধাবী শিক্ষার্থীরা জাতীয় রাজনীতির প্রতিটি কর্মকাণ্ড বিবেচনায় নিয়েছে।”
অতএব, ছাত্র সংগঠনগুলো যদি ভাবে আগের মতো দাপট ও পৃষ্ঠপোষকতার জোরে ভোট পাওয়া সম্ভব, তবে তারা বিভ্রান্ত।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: নেতৃত্বের উৎস
ডাকসুর ইতিহাসে আমরা দেখি—ছাত্রনেতারা জাতীয় নেতৃত্বে উঠে এসেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্ররাজনীতি দলীয় আধিপত্যে বন্দি হয়ে পড়েছে। আজ প্রশ্ন হলো—ডাকসু কি এখনও জাতীয় নেতৃত্ব গড়ার মতো সম্ভাবনা তৈরি করছে, নাকি কেবল ক্ষমতার খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে?শিক্ষার্থীদের রায়: সতর্কবার্তা
২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন তাই কেবল একটি ক্যাম্পাস ইভেন্ট নয়; এটি একটি সতর্কবার্তা।
এ রায় শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির প্রতিও এক ইঙ্গিত—
“আমরা পরিবর্তন চাই, তবে সেই পরিবর্তন হতে হবে স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য ও কল্যাণকেন্দ্রিক।”
আগামীর করণীয়
ডাকসুর এই নির্বাচন ছাত্ররাজনীতিকে নতুনভাবে ভাবার সুযোগ দিয়েছে। করণীয়গুলো হতে পারে—
১. ছাত্ররাজনীতিকে দলীয় আধিপত্য থেকে মুক্ত করা।
২. সহিংসতা, দখলদারিত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি বন্ধ করা।
৩. মেধা, যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে নেতৃত্ব গড়ে তোলা।
৪. শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যা—আবাসন, পাঠ্যসূচি, গবেষণা ও কর্মসংস্থান—এসবকে এজেন্ডার কেন্দ্রে রাখা।
আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি
আমার কাছে পরিষ্কার—ডাকসুর এই নির্বাচন কেবল একটি ফলাফল নয়, বরং একটি বার্তা। শিক্ষার্থীরা আর আগের মতো অন্ধভাবে অনুসরণ করবে না। তারা চাইছে পরিবর্তন, কিন্তু সেই পরিবর্তন হতে হবে বিশ্বাসযোগ্যতার আলোকে।
ডা. রুমির মন্তব্য তাই কেবল একটি প্রতিক্রিয়া নয়, বরং পুরো ছাত্ররাজনীতির জন্য যুগোপযোগী শিক্ষা। আমি মনে করি, যদি রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এই বার্তা গ্রহণ করে, তবে ছাত্ররাজনীতি আবারও তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারবে। আর যদি না পারে—শিক্ষার্থীরা অবশ্যই নতুন পথ খুঁজে নেবে।
২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—শিক্ষার্থীদের রায়ই ভবিষ্যতের রাজনীতির দিকনির্দেশ।
যদি আমরা তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পারি, তবে রাজনীতি আবারও মানুষের আস্থার প্রতিচ্ছবি হতে পারে। আর যদি না পারি—তাহলে ইতিহাসের পাতায় এ নির্বাচন শুধু সতর্কবার্তাই হয়ে থাকবে।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com