মহিউদ্দিন মোল্লা।।
বয়স তার ৭২ বছর। ডায়েরি লিখেন টানা ৫১ বছর। প্রতিদিন ১২টি ও শুক্রবার ২০টি পত্রিকা পড়েন। জমান পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। সেগুলো বাইন্ডিং করে রাখেন। তার বাসার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বই রয়েছে ৫হাজারের বেশি। তিনি সৈয়দ আবদুল কাইয়ুম। বর্তমানে মাধবপুর আলহাজ¦ মুহাম্মদ আবু জাহের ফাউন্ডেশন কলেজের অধ্যক্ষ। এর আগে তিনি লাউর ফতেপুর ব্যরিস্টার জাকির আহমেদ কলেজ ও শশীদল আলহাজ¦ মুহাম্মদ আবু তাহের কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি যেখানে গিয়েছেন সেখানে লাইব্রেরি গড়েছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বই প্রদান করেছেন। কলেজ ক্যাম্পাসে সবুজ বাগান গড়ে তুলেছেন। তার এসব কাজকে কেউ কেউ পাগলামি ভাবলেও তিনি তার কাজ অব্যাহত রেখেছেন। এসব কাজ করে যেতে চান আমৃত্যু। তিনি মনে করেন-এগুলোর মধ্য থেকে নেয়া জ্ঞান তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন।
তার কুমিল্লা নগরীর জিলা স্কুলের বাসায় গিয়ে দেখা যায়,ড্রয়িং রুম পুরোটা একটা লাইব্রেরি। বিশ্রামের বিছানা,ডাইনিং রুম,বেডরুম সর্বত্র বই আর পত্রিকার ছড়াছড়ি। তিনি সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কলেজে থাকেন। বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা। সন্ধ্যার পর থেকে লাইব্রেরির বই আর পত্রিকা পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। রাতে টিভিতে সংবাদপত্রের পর্যালোচনা দেখে বিছানায় যান। বাসায় গিয়ে দেখা যায়,তিনি পত্রিকা গুলো উল্টে দেখছেন। কোন শিক্ষণীয় প্রতিবেদন থাকলে তা কেটে রাখছেন। এছাড়া পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা গুলো আলাদা রাখছেন। সেগুলো বাইন্ডিং করেছেন। এখন ৪২খ- আছে। আরো ১২খ- বাঁধাই করতে দিয়েছেন। পত্রিকা পড়া শেষ করে বইতে চোখ বুলান। এরপর ডায়েরি খুলে বসেন। সারা দিনের কাজের উল্লেখযোগ্য অংশ লিখে রাখেন।
সৈয়দ আবদুল কাইয়ুম বলেন, শিক্ষাবিদ অজিত কুমার গুহ বলেছেন-যে শিক্ষক প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে যায় না সে শিক্ষক নয় ছাত্রের খুনি। এই বাক্যটি আমাকে খুব ভাবায়। তাই একটু পড়ার চেষ্টা করেন। ডায়েরি লিখেন ১৯৭২সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে। ক্লাসে স্যাররা যে বক্তব্য দেন তা মনে রাখা কষ্টকর হতো। লিখে রাখলে মনে থাকে। মুখস্ত করলে পড়া মনে থাকে না। তাই আত্মস্ত করতে হয়। আত্মস্ত করতে লিখে রাখা উত্তম। ১৯৭৪সাল থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখেন। ১৯৮০সালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি হয়। সেখানে তার একজন বস ছিলেন আবদুর রউফ ভুইয়া। তিনি তার জন্য বই ও ডায়েরি নিয়ে আসতেন। তিনি বলতেন- বই পড়ে ডায়েরিতে উল্লেখযোগ্য অংশ নোট করবে। পরের মাসে এলে আমাকে তার সারমর্ম বলবে। সেই থেকে বই পড়া ও ডায়েরি লেখা আরো গতি পায়।
তিনি বলেন,একটি পত্রিকা পড়ে আমার মনের ক্ষুধা মিটে না। মনে হয় কিছু বাদ পড়ে গেল। তাই প্রতিদিন ১২টি ও শুক্রবার ২০টি পত্রিকা পড়ি। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত। কথা বলতে গলে পড়তে হয়।
ডায়েরি লেখা নিয়ে মজার স্মৃতির বিষয়ে তিনি বলেন,তিনি এক বাসা বদলে আরেক বাসায় উঠেছেন। ৯বছর পর আগের বাসার মালিক তাকে জানান-তাকে নাকি এক মাসের বাসা ভাড়া ও বিদ্যুত বিল দেননি। তখন ডায়েরি খুলে দেখেন-লিখা আছে সেটি পরিশোধ করেছেন। সেই ডায়েরির পাতা ফটোকপি কর তাকে দেখালে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। এছাড়া পরিচিতজন স্বজন অনেকে তাদের পরিবারের জন্ম মৃত্যু বিয়ের তারিখ লিখে রাখেন না। পরে প্রয়োজন পড়লে তার কাছে জানতে আসেন। তিনি ডায়েরি দেখে তাদের বলে তারিখ দেন।
সকালে ও সন্ধ্যায় দুই কাপ চা খান। আর কোন অভ্যাস নেই। হাত খরচ এই পথে ব্যয় করেন।
মেয়ে ডা. সৈয়দা তাহসীন সিফাত কাশ্মীর বলেন,বাবা সারাক্ষণ পড়ায় ডুবে থাকেন। কলেজ থেকে বাসা সব সময় বই, পত্রিকা পড়া আর শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমরা যখন স্কুল কলেজে পড়েছি,তখনও তিনি আমাদের থেকে বেশি পড়তেন। আমরা হয়তো পরীক্ষার সময় রাত ১১টা পর্যন্ত পড়েছি। তিনি পড়েছেন ১২টার পর পর্যন্ত। তাকে কখনও পড়ায় হারাতে পারিনি। বই ও পত্রিকা পড়া বাবার কাছে নেশার মতো। এই নিয়ে তিনি আনন্দে থাকেন। বইয়ের নেশায় তাকে অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল কাইয়ুম হয়ে উঠতে সহযোগিতা করেছেন বলে মনি করি। নিজের পৃথক পেশা থাকলেও বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতেই আনন্দ বোধ করি।
সোনার বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা সৌরভ বলেন,ডায়েরি লেখা,বই ও পত্রিকা পড়ার দারুণ গুণ রয়েছে সৈয়দ আবদুল কাইয়ুমের। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার বই ও পত্রিকার সংগ্রহ বিতরণ করেন। তিনি বই ও পত্রিকা পড়ায় তার শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করে থাকেন।
সৈয়দ আবদুল কাইয়ুমের ছাত্র চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) মো. এরশাদ উদ্দিন বলেন,আমরা কলেজ জীবনে স্যারকে কাছে থেকে দেখেছি। এমন বই ও পত্রিকার প্রতি টান কম মানুষের দেখেছি। তিনি আমাদেরকেও বই ও পত্রিকা পড়ায় উৎ’সাহী করে তুলতেন। এমন গুণী মানুষ সমাজে বিরল। তার এই সংগ্রহ করা জ্ঞান সারা জীবন তিনি ছাত্রদের মাঝে বিলিয়েছেন। তাই সমাজে বিছু আলোকিত মানুষ গড়ে উঠেছে। তার মত আরো শিক্ষক বাড়লে সমাজ আরো আলোকিত হবে।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com