মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশ আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘ একদলীয় আধিপত্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন-সংগ্রাম ও দমন-পীড়নের অধ্যায় পেরিয়ে সামনে আসছে একটি সম্ভাবনার—একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এই সম্ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশের তিনটি ভিন্ন প্রজন্মের ভোটার—তরুণ, মধ্যবয়সী ও প্রবীণ। তাদের প্রত্যেকের চিন্তা, চাহিদা এবং স্বপ্ন আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারে।
তরুণ ভোটার: প্রত্যাখ্যান থেকে প্রত্যয়
বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক ১৩ কোটি ভোটারের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ ভোটার প্রায় ৬ কোটির মতো। এরা অনেকেই প্রথম বা দ্বিতীয়বার ভোট দিচ্ছেন। তারা বড় হয়েছে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও তথ্যপ্রবাহের যুগে। এই প্রজন্ম দুর্নীতি, রাজনৈতিক দমন এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক চাতুর্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা পরিবর্তনের এক আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত।
যদিও অনেকে রাজনীতি বিমুখ, কেউ কেউ হতাশ—তবুও যারা সোচ্চার, তারা বিশ্বাস করে স্বাধীনতা মানে কেবল পতাকা নয়—স্বাধীনতা মানে চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, ন্যায্য বিচার, এবং রাজনৈতিক জবাবদিহিতা।
মধ্যবয়সীরা: বাস্তবতার কঠিন পাঠশালা
৩৬ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের বলা যায়, বাংলাদেশের মধ্যবয়সী ভোটারগোষ্ঠী। এদের জীবনে রয়েছে চাকরি, সংসার, সন্তান, এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সংযুক্তি। তারা রাজনীতির চক্রাবর্তে বহুবার প্রতারিত হয়েছে, তাই এখন তারা কথা নয়, প্রমাণ দেখতে চায়।
এই শ্রেণি সরাসরি রাজপথে না নামলেও তারা ভোটে বড় প্রভাব রাখে। তারা স্থিতিশীলতা চায়, কিন্তু অন্ধ আনুগত্য নয়। একটি দায়িত্বশীল, স্বচ্ছ ও গণমুখী নেতৃত্ব এদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হলে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘নির্ধারক শ্রেণি’।
প্রবীণ প্রজন্ম: অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও শঙ্কা
৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের প্রবীণ ভোটারগণ আমাদের জাতির স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান অনেক সময় একরকম স্থির থাকলেও, অনেকেই সময়ের চাপে মত পরিবর্তন করেছেন।
তাঁদের একটি বড় অংশ স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার পক্ষে অবস্থান নেন। তবে রাজনীতির মূল্যবোধহীন অবক্ষয় দেখে অনেক প্রবীণও তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাচ্ছেন। তাঁদের রায় হবে অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সমন্বয়।
সম্ভাব্য রূপরেখা: ইতিহাস কি মোড় নেবে?
বাংলাদেশে যদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, তাহলে এই তিন প্রজন্মের ভোটারসমূহের অভিন্ন বা বিপরীত রায়ই নির্ধারণ করবে আগামী পাঁচ বছরের নয়, বরং আগামী পঁচিশ বছরের রাষ্ট্রদর্শন।
বিশ্লেষণ বলছে—তরুণ ও মধ্যবয়সী ভোটারদের মিলিত রায় ৭ কোটির বেশি ভোটে রূপ নিতে পারে। তার মানে, কেবল বয়স্ক বা চিরাচরিত ভোটব্যাংক নির্ভরতা নয়, নতুন করে বুঝতে হবে তরুণের চিন্তা, মধ্যবয়সীর হতাশা, এবং প্রবীণের অভিজ্ঞতার সমীকরণ।
রাজনীতি কি পারবে এই প্রজন্মান্তরের ভাষা শিখতে?
একটি নির্বাচন কেবল সরকার বদলের উৎসব নয়, এটি একটি জাতির আত্ম-পরিচয় নির্মাণের যাত্রা। প্রশ্ন হলো—এই যাত্রা কি আবারও পুরনো মুখের পুনরাবৃত্তি হবে, না কি নতুন একটি পথচলার ইতিহাস শুরু হবে?
রাজনীতিকদের এখন বুঝতে হবে—‘ক্ষমতা যার, দেশ তার’ নয়; বরং ‘জনগণ যার, দেশ তার’—এই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। যে দল বা জোট এই তিন প্রজন্মের চাহিদা ও ভাষা বোঝার সক্ষমতা দেখাবে, তাদের পক্ষেই আসতে পারে বিজয়। এপ্রিল হতে পারে একটি সম্ভাবনার জন্ম। ড. ইউনুস সম্প্রতি বলেছেন, আগামী এপ্রিলে নির্বাচন হতে পারে। এই সময়টি কেবল একটি রাজনৈতিক পর্ব নয়, এটি হতে পারে একটি জাতিগত পুনর্জাগরণ। যেখানে ভোট কেবল ব্যালট পেপারে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা হয়ে উঠবে একটি জাতির আত্মার প্রতিফলন।
তিন প্রজন্মের এই সংলগ্নতা যদি একটি সত্যিকার নির্বাচনী বিপ্লবের দিকে এগোয়, তবে ২০২৬ সাল শুধু আরেকটি সাল নয়—এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে "প্রজন্মান্তরের রায়" লেখার বছর। যেখানে কেবল একটি সরকার নয়, বদলাবে দৃষ্টিভঙ্গি, নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রচিন্তা।
সংক্ষিপ্ত বার্তা:
যাদের হাতে আগামী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, তাদের চোখে যেন আমরা দেখি নতুন সূর্যের প্রতিচ্ছবি। সেই সূর্য কার উপর উদিত হবে, তা নির্ধারণ করবে তিন প্রজন্মের অভিন্ন রায়।