বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের আয়োজনে বিজয় দিবস পালন উপলক্ষে গত সোমবার "বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বৈশ্বিক সচেতনতা শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি অধ্যাপক ড.আব্দুল জলিল চৌধুরী, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট তার মূল্যবান ভাষণে বলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যাকান্ড ও ব্রিটিশ শাসনের ধারাবাহিকতায় এ উপমহাদেশে গণহত্যার সংস্কৃতি শুরু হয়েছিলো । ব্রিটিশ শাসকদের ভাবধারায় দ্বিজাতি তত্বের উদ্ভব হয়। যার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে নিষ্পেষণের পদ্ধতিগত একটি প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও স্বাধিকার আন্দোলন এবং ৭০ এর নির্বাচন ছিল শোষণ, নিষ্পেষণের বিরোধ্যে প্রচন্ড রাজনৈতিক প্রত্যাঘাত।
উদ্বোধনী ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এর সূচনায় বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ নৃশংস সকল হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অনুষ্ঠানের সভাপতি কানাডা প্রবাসী গবেষক, সাংবাদিক, লেখক, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের সভাপতি ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কানাডা ইউনিট কম্যান্ড নির্বাহী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার জাহিদ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. এস. জে আনোয়ার জাহিদ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক এর সাবেক জেলা সভাপতি বদরুল হুদা জেনু।
বাংলাদেশে গণহত্যার ওপর আলোকপাত করে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট গবেষক, লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদগণের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) পরিচালক (প্রশাসন) ড. কামরুল হাসান, অধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী আলী আকবর মাসুম, শিক্ষিকা শিরিন ফেরদোসী, বার্ডের পরিচালক নাসিমা আক্তার, সাংবাদিক মো: সাজ্জাদ হোসাইন, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তান কোৱা হোসাইন ইভানা। এছাড়াও এতে অংশ গ্রহণ করেন নজরুল ইসলাম বাবুল, মো: ফিরোজ মিয়া, শামসুল হাবিব, এসরার জাহিদ, রাফাত হোসাইন প্রমুখ। এ ভার্চুয়াল আলোচনাটি আজ (সোমবার) বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় "অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, অতিথি অধ্যাপক আব্দুল জলিল চৌধুরীর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে যে বাংলাদেশে গণহত্যা নিয়ে আরো গবেষণার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে শহীদ মুক্তিযোদ্বা পরিবারগুলো এবং তাদের উত্তসূরীগণ এখনো সামাজিক বৈষম্যের শিকার, এখনো তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে হয় যা জাতি হিসেবে আমাদের ব্যথিত ও লজ্জিত করে..।
বদরুল হুদা জেনু বলেন, একাত্তরে গণহত্যা তথা বুদ্ধিজীবী হত্যার বেদনাদায়ক নজির কুমিল্লায় সংগঠিত নানা ঘটনা প্রবাহে ফুটে উঠে । শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য আমাদের বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করে নিতে হবে. অত্যন্ত লজ্জার ও পরিতাপের বিষয় হলো বিশ্ব মোড়লেরা গণহত্যার সংজ্ঞাকে তাদের সুবিধা মতো ব্যবহার করে আসছে। অপরদিকে পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ও বোধোদয় হচ্ছে। সেখানে একাত্তরে গণহত্যার নিন্দায় আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে।
ড. কামরুল হাসান শৈশবে তাঁর বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেককে হত্যার আবেগ তাড়িত একটি বর্ণনা দিয়ে বলেন, সরকারের উদাসীনতায় অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে দেশের শহীদ পরিবারগুলোকে। বাবুপাড়া বস্তি থেকে শুরু করে সকল শহীদদের রক্তের ঋণ আমরা আজ ও শোধ করতে পারিনি। মানবিকতার বোধ নিয়ে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
আলী আকবর মাসুম বলেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বৈশ্বিক সচেতনতার পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ জনগোষ্ঠীর কাছে ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্পষ্ট করে তুলতে হবে. বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে জাতীয় চার নেতা হত্যা ও গণহত্যা। প্রকৃত পক্ষে গণহত্যার দাবিকে সুদৃঢ় করতে আরো তথ্য সংগ্রহ ও কার্যকর গবেষণা শুরু করতে হবে, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে সংগঠিত করতে হবে।
শিক্ষিকা শিরিন ফেরদৌসী বলেন, হত্যা শুধু শারীরিক নয়, তা হতে পারে মনন, মেধা ও আবেগকে হত্যা। জীবিত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিকারভাবে মূল্যায়ন করতে হবে ও যথাযথ সন্মান দিতে হবে। বার্ড পরিচালক নাসিমা আক্তার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংজ্ঞায় অস্পষ্টতার কথা উল্লেখ করে এর প্রতিকারের দাবি জানান।
মো. সাজ্জাদ হোসেন, তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার স্মৃতি রোমন্থন করে জয়বাংলা স্লোগানকে বুকে ধারণ করার এবং এ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবারো উজ্জীবিত করার আহ্বান জানান। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সময়-উপযোগী স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা প্রদান ও ভাতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে আবারো তিনি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
কোৱা হোসেন ইভানা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ৭১ এর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নীরব স্বাক্ষী আমার দাদিমা তার মুখে ২৫ মার্চ রাতের কথা শুনে শরীর কেঁপে উঠে। আমার দাদা মোঃ সাদেক যিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ তাকে সে রাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়.
খায়রুল আহসান মানিক গণহত্যার সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের উপর জোর দিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সঙ্গবদ্ধ প্রচেষ্টার উপর জোর দেন।
সম্মানিত অতিথি অধ্যাপক ড.আব্দুল জলিল পাকিস্তান আমলে কিভাবে গণহত্যার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয় এর একটি ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে প্রফেসর নাজমুল করিম পরিবারের দেশত্যাগ ও একাত্তরে ধীরেন দত্তের হত্যাকান্ডকে তুলে ধরে এখনো নীরব গণহত্যা চলছে বলে দাবি করেন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং জাতীয় চারনেতার হত্যাকে গণহত্যা বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সভাপতির ভাষণে দেলোয়ার জাহিদ বলেন,পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরেরা একাত্তরে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে পরিকল্পিত ভাবে শত শত বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, হত্যা করেছে জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে, নারী, শিশু ও যুবককে। সংগঠিত করেছে ধর্ষণ, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগ সহ গুরুতর, সহিংস সকল মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও জাতিগত নির্মূলতা এবং গণহত্যা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে এসেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজেন্মর কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরতে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়িত করতে আমরা আজো সমর্থ্য হয়নি। এ ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের সকলকেই কাঁধে নিতে হবে এবং আবারো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। -প্রেস বিজ্ঞপ্তি।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com