।। অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ।।
চলতি বছর স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে। এ গরম কিংবা তাপপ্রবাহ শরীরের জন্য মোটেই সুখবর নয়। অসহনীয় গরমের কারণে হিট স্ট্রোকের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। প্রচন্ড গরমে কায়িক পরিশ্রমী রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমজীবী, দিনমজুর এসব শ্রেণির লোকেরা হিট স্ট্রোকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই এ হিট স্ট্রোকের লক্ষণগুলি জানা জরুরী। প্রাথমিকভাবে মাথাব্যথা ও মাংশপেশিতে ব্যথা হতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত তৃষ্ণা, অতিশয় দূর্বলতা, অবসাদ ও প্রচুর ঘাম হতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে অসংলগ্ন কথা, বিভ্রান্তি ও বমির ভাব হতে পারে। এছাড়াও অনেকের ঘাম না হওয়া বা জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মত পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। কেউ হিট স্ট্রোক হলে তৎক্ষনাত তার শরীরের কাপড় আলাদা করে দিতে হবে। পরিষ্কার ভেজা কাপড় দিয়ে দেহ মুছিয়ে দিতে হবে। রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে পানি খাওয়ানো যেতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। অতি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া দুপুরের তপ্ত রোদে বাড়ির বাইরে না বেরুনোই ভালো। আর বের হলেও সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরী, যেমনÑ পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং বাইরে যাওয়ার সময় বিশুদ্ধ খাবার পানি সঙ্গে রাখা। অতিরিক্ত রোদ থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহার করা, বাড়তি অংশযুক্ত টুপি ব্যবহার করা, সাদা বা হালকা রঙ্গের ঢিলেঢালা পোষাক পরিধান করা ইত্যাদি। এছাড়া প্রচন্ড গরমে ঘামের কারণে শরীরে লবনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই স্যালাইন জাতীয় পানীয় পান করা যেতে পারে। তাছাড়া এ গরমে হজম হয় এমন খাবার গ্রহন করতে হবে। অতিরিক্ত তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে, কাঁচা ফলমূল ও ভিটামিন সি যুক্ত খাবারগুলো প্রতিদিনের তালিকায় থাকতে হবে। বরফ শীতল কোমল পানীয় পানে সামান্য স্বস্তি পেলেও পরে সর্দিযুক্ত নানাহ জটিলতায় ভুগতে পারেন।
সবুজ এলাকা নষ্ট করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, মাঠসমূহ দখল ও জলাধার ভরাট চলছে নগরীর বিভিন্ন দিকে। নগর পরিকল্পনার মানদন্ড অনুযায়ী একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয় -জলধার থাকার কথা থাকলেও তা আছে কাগজে কলমে। দেশে এত গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রনালয়, প্রশাসন, পরিবেশবাদী সংগঠন তেমনি কাগজে কলমে। চোখ তুলে তাকালে বিল্ডিং দেখি, ডানে-বামে ঘুরলে দেয়াল আর ভবন দেখি। আকাশ দেখি না, বাতাস পাই না। রাস্তায় যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড আর গাড়ীর কালো ধোঁয়া তাতে বালু হারিয়ে গেছে। ব্যক্তি উন্নয়নে এবং উন্নয়ন কাজে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে সবুজ এলাকা ও জলাধারগুলো। এবারের উষ্ণ তাপ আমাদের আভাস দিয়ে গেল এখনি সবুজায়ন ও জলাধারগুলি রক্ষা না করলে অসহিষ্ণু হয়ে পড়বে পরবর্তী প্রজন্ম। থাকবে শুধু ইট পাথরের একটি শহর। কোন জনপদে জনসংখ্যার তিনগুণ গাছপালা থাকতে হয়। এক্ষেত্রে নগরগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। যা রীতিমতো চিন্তার বিষয়। প্রয়োজনের তুলনায় সবুজ কমে যাওয়া নগরবাসীর জন্য আরও বিপদ ডেকে আনছে বলে মনে করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর কুমিল্লার ব্যাংক আছে তবে ট্যাংক সব পুরিয়ে ফেলছে বা পুরানো হচ্ছে। দেখবালে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না।
কাজের সুবিধার্থে নগরীর আয়তন আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ডিগ্রি শাখা, রেলস্টেশন, শাসনগাছা বাস টার্মিনাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও চাঁদপুর এলাকা নগরীতে অন্তর্ভূক্ত হওয়া প্রয়োজন। চেষ্টা চলছে তবে এখনও হচ্ছে না। আয়তন আরো ৫০ বর্গ কিলোমিটার বাড়ানো প্রয়োজন। পশ্চিমে আলেখারচর, দক্ষিণে সুয়াগাজী, পূর্বে স্থলবন্দর অন্তর্ভূক্ত প্রয়োজন। এতে সামগ্রিকভাবে পুরো নগরজুড়ে প্রস্তাবিত ওয়াসার ব্যবস্থাপনার বিশুদ্ধ পানীয় জল ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থাপন করে নগরবাসীকে সন্তুষ্ট করা যেতে পারে। বিবিরবাজার রোডের পাশে যেভাবে বর্জ্য স্তুপিকাগারে ফেলে রাখা হচ্ছে তাতে অসুখ-বিসুখ ও ঐ এলাকার জনগণের প্রাকৃতিক বিড়ম্বনা দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। ইপিজেডের ইটিপির গলদ ব্যবস্থাপনা সদর দক্ষিণের এলাকাবাসীর বিভিন্ন অসুখ বিসুখের কারণ। সদর দক্ষিণ এলাকাবাসী এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়।
একসময়ের স্রোতস্বিনী, যৌবনী গোমতী আজ পুরাতন গোমতী নামে ‘লাইফ সাপোর্টে’। দখল, দূষণ আর ভরাটের প্রতিযোগীতায় মৃতপ্রায়। পুরাতন গোমতীর জমি দখল করে প্রায়শই গড়ে উঠেছে নতুন স্থাপনা। নদ-নদী, খাল-বিল উদ্ধারে সরকারের ঘোষণা এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা কোন কিছুই আমলে নিচ্ছে না অবৈধ দখলদাররা। দখলদারিত্বের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ভূমি অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলেও লোক মুখে শোনা যায়। কুমিল্লা নগরীকে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য দিতে পারে যে পুরাতন গোমতী তাকে রক্ষা করার কোন কার্যকরী উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এটি এখন দুই তীরের নগরবাসীর আবর্জনা ফেলার ভাগড় মাত্র। প্রতিনিয়ত দূষিত করছে পলিথিন মেশানো নগরীর বিভিন্ন আবর্জনা, গৃহস্থালি বর্জ্য, পরিত্যক্ত বর্জ্য, নদীর পাড়ে নির্মিত আধাকাঁচা পায়খানা। ফলে নদীর পানি গুণগত মানে অবনতি, মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতি, বাণিজ্য, কৃষি ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারের অনুপযোগী এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর দুদিকের বসতিরা একটু একটু করে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে কয়েকটি জায়গায় রাস্তা তৈরি ও বাঁধ দিয়ে স্বল্প দীর্ঘ একটি পুরাতন নদীকে খন্ড বিখন্ড করা হয়েছে। দুইপারে ওয়াকওয়ে তৈরি করে সবুজায়ন করলে এটি হতে পারে নগরীর ফুসফুস। পরিকল্পনা করে নতুন গোমতীকে সাথে নিয়ে নির্মাণ করা যায় হাতিরঝিলের মত একটি দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প।
গোমতী নদী যেটি বিবির বাজার থেকে মেঘনার মোহনায় গিয়ে মিশেছে সেটিই নতুন গোমতী। কয়েকজনের শক্তিশালী সিন্ডিকেট অবাধে গোমতীর মাটি কেটে বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করে আসছে। মাটি উত্তোলনের ফলে তারা পরিবেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে। ধূলা-বালিতে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। কেটে ফেলা হচ্ছে অসংখ্য বৃক্ষরাজি। মাটি কেটে গোমতীর দুধারকে ক্ষতবিক্ষত করে রেখেছে। বাপা ও বিভিন্ন সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ‘গোমতী বাঁচাও’ আন্দোলনের ডাক প্রশাসন ও মাটি খেকু কারোরই কর্ণপাত হচ্ছে না।
সর্বোচ্চ ১/৩ ভাগ পাহাড়ের উচ্চতা কমিয়ে সমতল ভূমি সৃষ্টি করে স্থাপনার চেয়ে অধিক ভূমি খালি রেখে নির্মাণ কাজ করতে হবে এবং নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর পরই ঐ খালিস্থানে বাগান ও বন সৃষ্টি করতে হবে। কোনক্রমেই রাস্তা, ড্রেন ও ইমারত ছাড়া ইট সিমেন্টের কাজ করা যাবে না এবং বনও উজাড় করা যাবে না বলে এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিও আহ্বান রেখেছেন পরিবেশবিদগণ।
গার্বেজ হাউস থেকে প্রতিদিন আবর্জনা পরিস্কারের নিয়ম নিশ্চিত করে যেখানে ডাম্পিং করা হয় সেস্থানে সার তৈরির কারখানাও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা স্থাপন করে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু করলে নগরবাসী ও নগর পার্শ¦বর্তীরা সুদিনের নাগাল পাবে। বর্তমানে যে ড্রেনেজ সিস্টেম আছে তাতে ড্রেন রাস্তার চেয়ে উঁচু, ফলে ড্রেনের পানি রাস্তায় আসে রোগজীবানুসহ। তাই রাস্তার একপাশ দিয়ে হলেও ম্যানহাইট কনসিলড পিভিসি পাইপ দিয়ে সমগ্র নগরীকে সাজিয়ে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়া হোক।
ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করে মানুষের ফুটপাত করতে হবে। চকবাজার শাসনগাছা বা সকল বাস স্ট্যান্ডের সীমানার বাইরে বাস থামানো বা বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা নিষিদ্ধ করতে হবে। রাজগঞ্জ বাজার, রাণীর বাজারসহ সকল বাজার তিনতলা ভবনে রূপান্তরিত করে দোতালা ও তিন তলায় বাজার স্থাপন করে নীচতলায় রিক্সা স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ড ও গাড়ী রাখার স্থান নির্ধারণ করা যায়। রাস্তার পাশের্^ সিটি কর্পোরেশনের জায়গায় অনেকে ভাড়া দিয়ে অস্থায়ীভবন নির্মাণ করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এগুলোও তিন-চারতলা বিল্ডিং করে নিচে গাড়ি ও রিক্সা স্ট্যান্ড করে দিলে কুমিল্লা শহরে কোন যানজট থাকবে না বলে পরিবেশবাদীরা মনে করে।
বহুতল ভবন নির্মাণে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ১৯৯৩ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। ভবনের সামনে বা চারপাশের খোলা জায়গা কোন অবস্থাতেই পাকা না করে সেখানে উপযুক্ত প্রজাতির ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানো প্রনিধানযোগ্য। নগরীর অনেকগুলো রাস্তার পাশে যেমন- স্টেডিয়াম রোড, আদালত সড়ক, মেউনিসিপাল পার্ক রোডের বৃক্ষরাজি কেটে ফেলা হয়েছে। পরবর্তীতে আর কোন বৃক্ষ নিধন নয় তবে যেখানে গাছকাটা হয়েছে সেখানে একটির বদলে তিনটি বৃক্ষরোপন করা যুক্তিযুক্ত। বড় বড় শাহী অট্টালিকার চতুস্পার্শে ও রাস্তার দুপাশকে সবুজায়নের অগ্রাধিকার দিয়ে, পুকুর ভরাট বন্ধ রেখে নগরজীবন সহনীয় রাখতে রইল সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান। আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস’২৪ সফল হোক, স্বার্থক হোক এটাই বিশ্ববাসীর কামনা।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com