নদী ও প্রেমের মৃত্যু

 

মনোয়ার হোসেন রতন ।।

বাংলাদেশ—যেন মায়ের কোলে ঘুমন্ত নদীর দেশ। শত শত বছরের স্রোতধারায় এ ভূমি গড়ে উঠেছিল পদ্মা-মেঘনার দোলায়, যমুনার নীরব বুকে, কর্ণফুলীর নীল স্রোতে। একসময় বলা হতো তেরশত নদীর দেশ। কত শত নদীর নাম উচ্চারণে সঙ্গীতের মতো ধ্বনি বাজত—শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, গোমতি, তিস্তা, আত্রাই, মনু, কুশিয়ারা, সুরমা, ফেনী, মাতামুহুরি, হালদা, বংশী, কালনী, বেতনা, চিত্রা, মধুমতি, ইছামতী, টাঙ্গন, নাগর, পায়রা, আন্ডারমানিক, শঙ্খ, বড় ফেনী, ছোট ফেনী। নদীর বুকেই জন্ম নিত ধান, শস্য, কবিতা। নদীর স্রোতে মিলত প্রেম, প্রকৃতির অনন্ত দর্শন।

কিন্তু আজ? নদী যেন নেই, প্রেম নেই, মানুষের আত্মার স্রোত নেই। তেরশত নদীর দেশ শুকিয়ে গেছে মানুষের উদাসীনতায়, দখলে, লোভে। এক অদ্ভুত শূন্যতা এখন বাংলাদেশে—যেন নদী হারানো মানেই প্রেম হারানো, প্রকৃতি হারানো।

নদী ও মানুষের আত্মার বন্ধন

নদী শুধু জল নয়—নদী মানে শ্বাসপ্রশ্বাসের ছন্দ, জীবনের তন্ত্রী। নদীর মতই মানুষ বয়ে চলে, বাঁক নেয়, মিলিয়ে যায় স্রোতে। নদী যেমন মাটি কেটে চলে যায় সমুদ্রের খোঁজে, তেমনি মানুষও চলে যায় প্রেমের খোঁজে। নদীর মতোই মানুষের হৃদয় একদিন পূর্ণ স্রোতস্বিনী ছিল—অবারিত, উদার, বর্ণিল।

আজ নদী নেই, কারণ আমরা প্রকৃতিকে ভুলেছি। প্রকৃতিকে ভুলে প্রেম হারিয়েছি। নদীর মতো সম্পর্ক, নদীর মতো উদারতা, নদীর মতো দর্শন শুকিয়ে গেছে মানুষের অন্তরে। নদীর বাঁধন ছিঁড়ে গেছে, মানুষের আত্মার বাঁধনও ছিঁড়ে গেছে।

তেরশত নদীর মৃত্যু

তেরশত নদীর দেশ হারিয়ে গেছে নিঃশব্দে। শহরের কংক্রিটের দমবন্ধ চাপে নদীগুলো হয়েছে বন্দি। লোভের শিকল বেঁধেছে স্রোতকে। নদী মরে গেছে, নদীর বুকে হাঁসের খেলা মরে গেছে, নদীর ঢেউয়ে লেখা কবিতা মরে গেছে।

যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলি, তিস্তা, গোমতি, সুরমা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, আত্রাই, ফেনী, কালনী, বংশী, চিত্রা, মধুমতি, পায়রা, ইছামতী, মাতামুহুরি একদিন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির আত্মার পথ ছিল, যে নদী ছিল মা-বোনের চোখের জল, সেই নদী আজ নেই। নদীর মৃত্যু মানেই জীবনের মৃত্যু, প্রেমের মৃত্যু, দর্শনের মৃত্যু।

প্রকৃতি ও প্রেমের বিচ্ছেদ

একসময় বাংলার মানুষ ছিল নদীর সন্তান। নদীর জলে তারা হাসতো, নদীর কাদায় খেত বুনতো, নদীর তীরে গান গাইতো। প্রেম ছিল নদীর মতো—প্রশস্ত, গভীর, ধীর অথচ অপ্রতিরোধ্য।

আজ নদী শুকিয়ে গেছে মানুষও শুকিয়ে গেছে। প্রেম নেই, কারণ নদী নেই। হৃদয় হয়ে গেছে মরুভূমি। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ যন্ত্রের মতো চলাফেরা করছে—নদীর স্রোত ভুলে যাওয়া মানুষ যেন নিজেরই আত্মাকে হারিয়ে ফেলেছে।

নদীর দর্শন—জীবনের দর্শন

নদী আমাদের শিখিয়েছে—বয়ে চলতে হয়, থেমে থাকলে মৃত্যু। শিখিয়েছে—বাঁক নিতে হয়, তবেই সমুদ্রের দেখা মেলে। নদী শিখিয়েছে—সংগ্রাম করো, পাহাড় ঠেলে পথ তৈরি করো।

আজ নদী না থাকায় সেই দর্শনও নেই। নদীকে মেরে মানুষ নিজের আত্মাকে মেরেছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ হারানো মানে শুধু ভূগোল নয়, এটা মানুষের অন্তরের শূন্যতা, আত্মিক ধ্বংস।

নদীকে ফিরিয়ে আনতে হবে প্রেমে

বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে হলে নদী ফিরিয়ে আনতেই হবে। নদীর স্রোত চললে মানুষের প্রেমও চলবে। নদীর বাঁক বাঁচলে মানুষের হাসিও বাঁচবে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশ মানে শুধু মানচিত্রের নদী নয়—এটা আত্মার নদী, প্রেমের নদী।

আজ আমরা যদি নদীকে বাঁচাতে না পারি, প্রেমকে ফিরিয়ে না আনি, প্রকৃতিকে আলিঙ্গন না করি—তাহলে বাংলাদেশ কেবল ইতিহাসে থাকবে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। বাস্তবে থাকবে শুষ্ক, প্রেমহীন এক মরুভূমি।

নদী হারানো মানে শুধু পানির ক্ষয় নয়—এটা আত্মার ক্ষয়। আমাদের নদীকে ফিরিয়ে আনতে হবে হৃদয়ে, প্রেমে, প্রকৃতির কোলে। তবেই আবার বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের নদীমাতৃক দেশ—যেখানে পদ্মা-মেঘনার মতো, যমুনা-তিস্তার মতো, কর্ণফুলি-হালদার মতো, সুরমা-কুশিয়ারার মতো, বংশী-চিত্রার মতো, পায়রা-ইছামতীর মতো, ফেনী-মাতামুহুরির-গোমতির মতো বয়ে যাবে প্রেম, প্রকৃতি আর জীবনের অমৃত দর্শন।

inside post
আরো পড়ুন