------- মতিন সৈকত --------
বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে 'বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কি,মি, এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লক্ষ হেক্টর: যা দেশের মোট আয়তনের ১৫,৫৮%। বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমান প্রায় ১৬ লক্ষ হেক্টর: যা দেশের আয়তনের প্রায় ১০.৭৪%। বাংলাদেশের বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ দেশের মোট আয়তনের ২২,৩৭%।' বাংলাদেশে নানারকম বন আছে। পাহাড়ি বন, প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন,সৃজিত উপকূলীয় বন, শাল বন, জলাভূমির বন।'
বন রক্ষা, বন্যপ্রাণী নিধন এবং হত্যা বন্ধ করতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকরী ভূমিকা অপরিহার্য। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বিল বোর্ড, সাইনবোর্ডে বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন উল্লেখ করতে হবে। বন্যপ্রাণীর প্রয়েজনীয়তা এবং জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব জনগণকে বুঝাতে হবে। যেসব জায়গায় বন্যপ্রাণী ফসল নষ্ট করে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশংকা থাকে তাদেরকে আগ থেকেই সরকারিভাবে আর্থিক নিরাপত্তা দিয়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং বন প্রহরী হিসেবে মাসিক অথবা বার্ষিক সন্মানী ভাতা দিয়ে সম্পৃক্ত করলে বন,বন্যপ্রাণী, বন সম্পদ, পাহাড়ের অমূল্য রত্ন রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিভিন্ন মিডিয়ায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার প্রসার করতে হবে। বিজ্ঞাপন দিয়ে সচেতন করতে হবে। পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বন অধিদপ্তরের উদ্যোগে এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, মাইকিং এবং লিফলেট বিতরণ করে জণগণের সচেতনতা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন সভা সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে বনায়ন সৃষ্টিতে, বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে।
মানুষ এবং বন্যপ্রাণী দ্বন্দ্ব নিরসনে এবং বন্ধুত্ত সৃষ্টিতে দীর্ঘ মেয়াদি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, অভয়াশ্রমে তাদের খাদ্যের জন্য কলা, কাঁঠাল, আম,জাম,ডেউয়া, লটকন, ডুমুর, আলু, টমেটো সহ প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট ফল, ফসলের গাছ লাগাতে হবে। পাহাড় পর্বত কেটে বন উজাড় করে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করা যাবেনা।
আল্লাহ কোন কিছু অনর্থক সৃষ্টি করেন নাই। আমাদেরকে যেমন পরম মমতায় খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন তেমনি বন্যপ্রাণী সহ প্রত্যেকটি সৃষ্টি আল্লাহর মাখলুকাত। তারা তাদের মত বনে বসবাস করে, বংশ বিস্তার ঘটায়। তাদের একটি নিজস্ব ভূবন আছে। নিজস্ব প্রাণী জগৎ আছে। বন্যপ্রাণীদের উত্যক্ত করা পাপ। বন্যেরা বনে সুন্দর। বন্যপ্রাণী বনেই বাস করে।
মানুষ চলাচলের প্রয়োজনে বন কেটে পাহাড় বিলীন করে সড়ক, মহাসড়ক তৈরি করেছে। বনাঞ্চল সাবাড় করে
জনবসতি, স্কুল, কলেজ, হাট,বাজার, হাসপাতাল, বিদুৎ কেন্দ্র, মোবাইল টাওয়ার, কলকারখানা সহ কত রকমের স্থাপনা নির্মাণ করে শহর বানিয়ে ফেলেছে। বন্যপ্রাণী এক স্থান থেকে আরেক স্থানের যাতায়াতের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগানোর পরেও অনেকে কৌতূহল বশত উৎসুকভাবে নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবেই বন্যপ্রাণীর প্রতি ঢিল নিক্ষেপ করে , বাঁশ, লাটি নিয়ে তেড়ে যায়, ভিডিও করে, বন্যপ্রাণী তেড়ে আসলে ভয় পেয়ে দ্রুত হিতাহিত জ্ঞান বিবর্জিত কর্মকাণ্ড করে বসে। এতে হাতি সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ক্ষেপে উঠে আক্রমণ করে আহত নিহত করে ফেলে।
বন অক্ষত রাখতে হবে। বনায়ন বাড়াতে হবে। একটি দেশের আয়তনের সিকি ভাগ প্রাকৃতিক বন অপরিহার্য।
বন সম্পদের উপর দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি নির্ভর করে। বৈশ্বিক জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশের তালিকায় আমাদের বাংলাদেশ। আমরা বাঁচতে হলে আমাদের দেশকে বাঁচাতে হবে। সে জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণগুলো চিহ্নিত করে তার থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করতে হবে। সুন্দর বন, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ময়মনসিংহের গারোপাহাড় এবং সবধরনের পাহাড় পর্বত টিলা, উচু ভূমি এবং বন, বনায়ন, বন্যপ্রাণী আবাসস্থল রক্ষা করতে হবে। খাল,বিল,নদী, নালা,ছড়া, ঝর্ণাধারা অবারিত জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের ঝাউবন,প্যারাবন সহ সবধরনের গাছের আবাদ বাড়াতে হবে।
মিয়ানমারের উদ্বাস্তু প্রায় পনের লক্ষ শরনার্থী বাংলাদেশে বাস করছে। যাদের সংখ্যা প্রতিদিন দ্রুত হারে বাড়ছে। তাদের কারণে কক্সবাজারের বৃহত্তর অঞ্চলেরর প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বন ও বন্যপ্রাণী আবাসস্থল ব্যাপকভাবে বিলীন হয়ে গেছে। তাদের সাময়িক আশ্রয়, চরম দূর্যোগের মুহূর্তে মানবতার প্রয়োজনে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে বিপাকে পড়ে গেছে। সরকারের অদূরদর্শীতার খেসারত দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন করানো যাচ্ছেনা। জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। মিয়ানমার তাদের উদ্বাস্তু শরনার্থীদেরকে ফিরিয়ে নিচ্ছেনা। এ সমস্যা বাংলাদেশের জন্য গোদের উপর বিষ ফোড়া।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ঘন বসতি দেশ। নিজের দেশের জনসংখ্যা নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। তার উপর নিয়মিত প্রাকৃতিক দূর্যোগের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরনার্থী সমস্যা বাংলাদেশকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। তাদের কারণে ভয়ংকরভাবে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। বন, বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম, পরিবেশ, প্রকৃতির জন্য, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বেরের স্বার্থে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে হবে।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে সরকার সর্বমোট ৫১টি সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে। তারমধ্যে ১৯টি জাতীয় উদ্যান, ১টি উদ্ভিদ উদ্যান, ২৪টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ২টি বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা, ৩টি ইকোপার্ক, ২টি মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া ২টি শকুন নিরাপদ এলাকা বাস্তবায়ন করছে। এগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি আরও যেসব বনাঞ্চল আছে সেগুলো ও যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করতে হবে।
Iucn এর ২০১৫ সালের জরীপে বাংলাদেশে বর্তমানে ১১৬৩ প্রজাতির মেরুদণ্ডি বন্যপ্রাণী রয়েছে। ৪৯টি উভয়চর, ১৬৭টি সরীসৃপ, ৫৬৬টি পাখি, ১৩৮টি স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৫৩ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে ১৪১টি ক্রাইস্টাসিয়ান ও ৩০৫টি প্রজাতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীসহ সর্বমোট ১৬১৯টি প্রজাতি রয়েছে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরে রয়েছে অসংখ্য জীববৈচিত্র্যের সমাহার। রয়েছে বিরল বিপন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী অস্তিত্ব। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ।
তরুণ প্রজন্মকে জীববৈচিত্র্য, বন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সহ পরিবেশ বক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে স্বেচ্ছাসেবী এবং গবেষক হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে।
বন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দিবসগুলো ব্যাপকভাবে জাতীয় পর্যায়ে থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবধরনের জনগণের কাছে গুরুত্ব অনুধাবন করাতে হবে। নিমোক্ত দিবসগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য জনগণকে জানাতে হবে।
২ ফেব্রুয়ারী বিশ্ব জলাভূমি দিবস, ৩ মার্চ বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস, ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস, ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস, ১৮ এপ্রিল বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস, ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস, ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস, ২৩ মে আন্তর্জাতিক কাছিম দিবস, ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস, ৮ জুন বিশ্ব সমুদ্র দিবস, ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস, ১২ আগস্ট বিশ্ব হাতি দিবস, সেপ্টেম্বরের প্রথম শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস, ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস, ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবস, ১০ অক্টোবর বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস, ২৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মিঠা পানির ডলফিন দিবস,
৪ ডিসেম্বর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ দিবস।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বন অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত তথ্য কণিকা ২০২২ থেকে জানা যায়। ১, পৃথিবীতে বনভূমির পরিমাণ ৩১℅,
২, পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ৯৮% বনভূমির দেশ ফ্রেঞ্চ গুয়ানা,
৩, রাশিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, আমেরিকা, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কঙ্গো, ইন্দোনেশিয়া, পেরু এবং ভারতে পৃথিবীর ৬৬% বন আছে।
৪, কাতার জিব্রালটার, হলি সি, মোনাকা, সান ম্যারিনো, সেন্ট ব্যাথেলিমাই, ফকল্যান্ড, আইল্যান্ড ও সালবার্ড এবং জেনমেইন আইল্যান্ডে কোন বনভূমি নাই।
৫, প্রতিদিন ২০০ বর্গকিলোমিটার বন হারিয়ে যাচ্ছে।
৬, প্রায় ১,৬ বিলিয়ন মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য বনের উপর নির্ভরশীল।
৭, পৃথিবীতে ৩০০ মিলিয়নের অধিক লোক বনে বাস করে।
৮, পৃথিবীর স্থলভাগের জীববৈচিত্র্যের, ৮০% বন ধারণ করে।
৯, পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ৪০% এর বেশি Tropical Rainforest থেকে উৎপন্ন হয়।
১০, পৃথিবীর মোট গ্রীন হাউস গ্যাসের ১৭,৪% এর বেশি ডিফরস্টেশন এবং ফরেস্ট ডিগ্রেডেশন থেকে নির্গত হয়।'
লেখক, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় পরিবেশ পদক এবং দুইবার জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রাপ্ত এগ্রিকালচারাল ইম্পরট্যান্ট পারসন এআইপি।
matinsaikot507@gmeil, 01818-866522
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com