আনাস ইবনে মালেক (রা:) বর্ণিত এক হাদিসে আছে “গাছ লাগাও, চাষাবাদ কর। এটাও তোমার জন্য সাদাকা বা দান হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ তোমার উৎপন্ন ফসল তো মানুষ বা কোন প্রাণীই খাবে।” বোখারী শরীফের আকেটি হাদিসে লেখা রয়েছে “যদি তুমি নিশ্চিত হও যে, আগামীকাল কেয়ামত হবে তারপরও আজকে যদি তোমার কাছে গাছের একটি বীজ থাকে, তা বপন করো আর চারা থাকলে তা রোপন করো।” অনুরূপ মুসলিম শরীফে উল্লেখিত আছে “ফলদ বনজ ভেষজ- যে কোন গাছ লাগানো সাদাকা। এ গাছ থেকে যত পশু, প্রাণী বা মানুষ উপকৃত হবে, তা সদকায়ে জারিয়া হিসেবে গাছ রোপনকারীর নামে লেখা হতে থাকবে।”
ছায়াঘেরা, ঘুঘুডাকা সবুজ শ্যামল আমাদের দেশটা আর আগের মত নেই। আমাদের দেশটাকে সবুজ শ্যামল বলা হত যে সকল কারণে তার অন্যতম উপাদানটি হল চারিপার্শ্বে ঘন ঘন গাছ-বৃক্ষরাজি আর সবুজের সমারোহ। বর্তমানে বাংলার সেই সবুজ শ্যামলিমা খুব কমই চোখে পড়ে। সবুজ বৃক্ষরাজি ও ফসলি জমি অকাতরে ধ্বংসের কারণে পাখপাখালিও পূর্বের ন্যায় দৃশ্যত নয়। গাছপালা কেটে ফেলার কারণে পাখিদের আশ্রয়স্থল সংকুচিত হয়ে আসছে। হরদম গাছপালা কাটা হলে পাখিকুলের বংশবৃদ্ধিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে পরিবেশবাদীরা সবসময় মনে করে। জনসংখ্যার অধিক চাপে ও ব্যাপক নগরায়নে ফসলি জমি উজাড় করে তৈরি হচ্ছে ঘরবাড়ি ও বহুতল ভবন। হরহামেশা কাটা হচ্ছে গাছপালা বন বৃক্ষরাজি। কেউ মানছে না নিয়মনীতি। পরিবেশ তাই-আজ হুমকির মুখে। চতুর্দিকে ব্যাপক হারে গাছপালা ও ফসলি জমি বিলীন হতে থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। খাদ্যভাব প্রকট আকার ধারণ করবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ লাগানোর কোন বিকল্প নাই। আগেকার দিনে চারদিকে যে পরিমাণে গাছপালা দেখা যেত তার তিন ভাগের ১ ভাগও এখন পরিলক্ষিত হয় না। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। এমনিতেই বিজ্ঞানীরা দেশ পানিতে ডুবে যাওয়ার সতর্কবাণী দিয়ে যাচ্ছেন।
আগের দিনে গ্রামাঞ্চলে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, সফেদা, শরীফা, আতা, লেবু, সুপারি, ডালিম, নারিকেল, কলা, আনারস হরেক প্রজাতির ফলের উৎপাদন হত। এখন যে পরিমাণে উৎপাদন হয় তা দিয়ে মানুষের চাহিদা পূরণ হয় না। কারণ এসব গাছ এখন আর আগের মত দেখা যায় না। বিশেষ করে শরীফা, আতা, সফেদা ও ডালিম এখনকার প্রজন্ম চিনেও না, খায়ও না। ফলবান বৃক্ষ নিধন করে বসতি নির্মাণ হচ্ছে। শহরে যদিও ছাদে বাগান করার অভ্যাস কিছুটা গড়ে উঠেছে কিন্তু বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। দুই বিল্ডিংয়ের মাঝের আঙ্গিনা রক্ষা করে সবুজায়নের কথা আইনে লেখা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বেপরোয়াভাবে গাছ কাটলে তেমন কোন প্রতিবাদও হয় না। ফলে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মিছিলে নেমে পড়েছে অনেক অসাধুচক্র।
আজকের দিনের শিশু কিশোরদের কাছে আগের দিনে ফল ফলাদির কথা বললে তারা বিশ্বাসই করতে চায় না। সেইদিন আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য দরকার অধিক হারে বৃক্ষ রোপন। গাছে গাছে ফুলে ফলে ভরে উঠুক আমাদের বাড়ির আঙ্গিনা। স্কুল, প্রতিষ্ঠান, বাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। বৃক্ষ নিধনের কর্মসূচি এভাবে চলমান থাকলে মানবজীবন হুমকির মুখে পড়বে। পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে। দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। পৃথিবী ধংসের মুখোমুখি হবে। তাই গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। “গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান”-এই হোক আমাদের সকলের শ্লোগান। ফসলি বা আবাদী জমি রক্ষা করতে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের মত ছোট দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ফসলি জমি ধংস করে সবাই বাড়ি ঘর নির্মাণ করবে এটাই স্বাভাবিক। ফসলি জমি ও গাছপালা নষ্ট করে ইমারত নির্মাণের ফলে একসময় দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। তাছাড়া এভাবে গাছপালা কমতে থাকলে মানুষ অক্সিজেনের অভাবে ভুগবে। বিশুদ্ধ বায়ুর অভাবে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগের জন্ম নেবে। তাই জনসংখ্যার মত আমাদের প্রধান জাতীয় সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফলে অবাধে গাছকাটা বন্ধ হবে, দেশ আবার সত্যিকার অর্থে সবুজ শ্যামল হয়ে ভরে উঠবে।
লেখক:সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
ও
সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com