হাবিবুর রহমান।।
জীবনে ভ্রমণের মাধুর্য তখনই পরিপূর্ণতা পায়, যখন প্রিয়জনের সাথে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কাছে থেকে অনুভব করা যায়। পাহাড়ের নির্জনতা, সমুদ্রের ঢেউয়ের কোলাহল-একদিকে শান্তি, অন্যদিকে প্রাণের উচ্ছ্বাস। এই দুই বিপরীতধর্মী অভিজ্ঞতা মানুষকে প্রকৃতির গভীরে টেনে নিয়ে যায়। সদ্য বিবাহিত জীবনসঙ্গী নওরিন আজুবা এবং আমার বাবা-মায়ের সাথে বান্দরবান ও কক্সবাজার ভ্রমণ ছিল এমনই এক অভিজ্ঞতা, যা সারাজীবন হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে।
২১ জানুয়ারি, ২০২৫। বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট। কুমিল্লা থেকে জিপ গাড়িতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যায় আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছে নাসিরাবাদ ফিনলে মার্কেটে কিছু কেনাকাটা করি। এরপর রাত ৯টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম অফিসার্স মেসে রাতের খাবার খেয়ে রাত্রি যাপন করি। মেসটির পরিবেশ এবং আতিথেয়তায় অভিভূত হয়ে গেলাম, বিশেষত এমন একটি জায়গায় থাকার কৌতূহল বহুদিন ধরেই আমার মনে বাসা বেঁধেছিল।
পাহাড়ের আহ্বান॥
২২ জানুয়ারি সকালে আমরা মারশা বাসে করে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। দুপুর ১টায় আমরা বান্দরবানের মেঘলায় অবস্থিত হলিডে ইন রিসোর্টে পৌঁছাই। প্রাথমিক বিশ্রাম শেষে আমরা মেঘলা লেক এবং নীলাচল সুউচ্চ পাহাড় পরিদর্শনে যাই। নীলাচলের কুয়াশা-ঢাকা পাহাড় আর সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য যেন জীবনের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল। বাবার গানের সুর যেন পাহাড়ের স্নিগ্ধ পরিবেশকে আরো জাদুকরী করে তুলেছিল। সন্ধ্যায় বান্দরবান এসে উঠেছি অফিসার্স মেসে। সুন্দর নকশা আর পরিপাটি পরিবেশে ২০২০ সালে নির্মিত তিন তলা ভবনের এই মেসটি এক কথায় আধুনিকতার নিদর্শন। বান্দরবান অফিসার্স মেসে শুধু স্থাপত্যের সৌন্দর্যই নয়, কর্মরত স্টাফদের ব্যবহারও ছিল অনন্য। বিকেলের আলো নিভে আসার পর ডিনারের সময়টুকু হলো নতুন অভিজ্ঞতার সূচনা। মেসে সংগৃহীত "ব্যাম্বু চিকেন" এর স্বাদ পেলাম। দেশি মুরগি তেল-মসলা দিয়ে বাঁশের ভেতরে ঢুকিয়ে বিশেষ কৌশলে রান্না করা হয় এই খাবারটি। প্রথমবার স্বাদ নিলাম এই অনন্য রান্নার। আহা! বাঁশের মৃদু সুগন্ধ আর দেশি মসলার মিশ্রণে এমন মুরগির স্বাদ আগে কখনোই পাইনি। প্রতিটি কামড় যেন প্রকৃতির সজীবতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। অফিসার্স মেসের পরিবেশটিও প্রশংসনীয়। চারপাশে পাহাড়ের ছোঁয়া, নির্মল বাতাস আর আভিজাত্যের ছাপ আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাঁশের মতো সাধারণ একটি উপকরণ দিয়ে এমন সুস্বাদু খাবার তৈরি সম্ভব-মানুষের সৃজনশীলতা সত্যিই অবাক করার মতো।
বান্দরবানের সোনালি সকাল॥
২৩ জানুয়ারি সকালে সাঙ্গু নদী, মিলনছড়ি পাহাড় এবং শৈলপ্রপাত ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হলো। এখানকার শান্ত পরিবেশ, পাহাড়ের মাঝে নদীর বয়ে চলা স্রোত আমাদের মন ভরিয়ে দিল। দুপুরের খাবার শেষে আমরা মাইক্রোবাসে করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দীর্ঘ যাত্রার পর সমুদ্রের ঢেউয়ের ডাক যেন আমাদের ক্লান্তি নিমেষেই দূর করে দিল।
প্রথম সাক্ষাৎ: বঙ্গোপসাগরের সৈকতে সূর্যাস্ত॥
২৩-১-২০২৫ তারিখ বিকালে কক্সবাজারে পৌঁছে আমরা অফিসার্স মেসে উঠি। বিকেলের নরম রোদ আর মৃদু বাতাস আমাদের সঙ্গী করে প্রথমবারের মতো পা রাখি কক্সবাজারের লাবনী বিচে। সৈকতের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়েই মনে হলো, প্রকৃতির এক বিস্ময়ের সামনে এসে পৌঁছেছি। যত দূর চোখ যায়, ঢেউয়ের সাদা ফেনা আর নীল জলরাশির বিশাল বিস্তৃতি। প্রথমবার সাগরের দর্শন যেন হৃদয়ে এক অপার্থিব অনুভূতির জন্ম দেয়। ঢেউগুলো একের পর এক এগিয়ে এসে আমাদের পায়ের কাছে মৃদু চুম্বন করে ফিরে যাচ্ছিল। মনে হলো, সমুদ্র তার নিজস্ব ভাষায় আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসা লবণাক্ত গন্ধ আর ঢেউয়ের গর্জনে যেন প্রকৃতি এক গভীর সুর বাজিয়ে চলেছে, যা প্রাণের গভীরে মিশে যেতে বাধ্য।
পরদিন ২৪-১-২০২৫ তারিখ সকালে নাস্তা সেরে ৯ঃ৩০ মিনিটে আমরা মেরিন ড্রাইভ ধরে হিমছড়ি ঝরনা, ইনানী বিচ এবং পাটুয়ারটেকে সময় কাটালাম। প্যারাসেলিং, ঘোড়ার পিঠে চড়া, বীচ বাইকে ঘুরে বেড়ানো - এসব অভিজ্ঞতা আমাদের ভ্রমণকে আরো রোমাঞ্চকর করে তুলেছিল। বিকেলে লাবনী পয়েন্টে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার মুহূর্তটি ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়। সূর্যের গোধূলি আলো যখন সাগরের জলে মিলিয়ে যাচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল জীবনও যেন এই বিশাল প্রকৃতির অংশ। সূর্য আস্তে আস্তে সমুদ্রের বুকে ডুব দিচ্ছিল, আর আকাশ যেন রঙের পসরা সাজিয়ে বিদায়ী সূর্যকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল। লাল-কমলা আভায় আলোকিত জলরাশি যেন এক স্বপ্নময় দৃশ্যের মতো। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম - শব্দহীন, মুগ্ধ। মনে হলো, জীবনের সমস্ত ক্লান্তি যেন এই ঢেউয়ের সঙ্গেই মুছে যাচ্ছে।
২৫ জানুয়ারি, ২০২৫। সকালে সূর্যের প্রথম আলো যখন সমুদ্রের বুকে রুপালি আভা ছড়াচ্ছিল, আমরা বঙ্গোপসাগরের সৈকতে শেষবারের মতো প্রভাত হাঁটায় বের হলাম। সমুদ্রের নিরবচ্ছিন্ন ঢেউয়ের গর্জন আর পায়ের নিচে স্নিগ্ধ বালুর শীতলতা - প্রকৃতির এই নিবিড় স্পর্শ যেন আমাদের বিদায় জানাচ্ছিল এক নীরব ভালোবাসায়। সমুদ্রের পানি হাতে নিয়ে এরশাদ নিলাম, সেই সাথে সমুদ্রের বাতাসে মিশে থাকা লবণাক্ত ঘ্রাণ আর ঢেউয়ের খেলায় ভিজে যাওয়া বালুতে শেষবারের মতো পা রেখে মনে হলো, প্রকৃতি যেন বলছে, “তোমরা আবার ফিরে আসো।” বিদায় মুহূর্তে আমরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই অগণিত ঢেউয়ের দিকে, যা যেন বলছিল, "জীবন যেমন চলমান, তেমনি এ সমুদ্রও চিরকালীন।"
সৈকতের সেই শেষ প্রভাতে সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য আমাদের মনকে প্রশান্ত করল। হৃদয় ভারাক্রান্ত হলেও মনে শান্তি নিয়ে ফিরে এলাম, কারণ জানতাম - প্রকৃতি আর ভালোবাসার এই টান আমাদের আবার ফিরিয়ে আনবে।
সত্যিই, সমুদ্রের ঢেউ যেমন কখনও থামে না, তেমনি ভ্রমণের স্মৃতিগুলোও হৃদয়ে থেকে যায় চিরন্তন সুরের মতো।
পরদিন অর্থাৎ ২৫-১-২০২৫ তারিখ সকালে বাবা আমাদের কক্সবাজার-ঢাকা বিমানের টিকিট দিয়ে অবাক করে দিলেন। এই প্রথমবার বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা হলো আমার। কক্সবাজার এয়ারপোর্ট থেকে ৮:৫৫ মিনিটে নভোএয়ার ফ্লাইটে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে আমরা কুমিল্লায় ফিরে আসি।
এই ভ্রমণ শুধু পাহাড় এবং সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ দেয়নি; বরং পরিবারের সাথে সময় কাটানো, নতুন অভিজ্ঞতার সংস্পর্শ পাওয়া এবং প্রকৃতিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ দিয়েছে। পাহাড়ের নৈঃশব্দ্যে প্রশান্তি এবং সমুদ্রের ঢেউয়ে উচ্ছ্বাস যেন আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে।
বাবা-মা এর দোয়া এবং ভালোবাসায় যেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এভাবেই সুখময় হয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই, যিনি আমাদের সুস্থতার সাথে ভ্রমণ শেষ করার তৌফিক দিয়েছেন।
লেখক: এম.এসসি (গণিত)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com