পুড়ে যাওয়া ঘরের খুটিতে সাড়ে ১৪ আনা পয়সা!

।। খায়রুল আহসান মানিক ।।
১৯৭১ সাল। তখন আমি চিওড়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকে  প্রথম বর্ষের ছাত্র। ২৫ মার্চ রাতের পাক বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণ ও হত্যার খবর পর দিন সকালেই জানাজানি হয়ে যায়। সকালেই এলাকার ছাত্র,জনতা কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার চিওড়া বাজারে একত্রিত হয়। নেতৃস্থানীয়রা আলাপ আলোচনা করে ঢাকা- চট্রগ্রাম সড়ক বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাতে করে পাক বাহিনীর গাাড়ি এ সড়কে চলাচল করতে না পারে। সিদ্ধান্ত মতো সবাই সড়কে যাই। সেখানে সড়কের  আমজাদের বাজার ব্রিজে গিয়ে সেটা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। সড়কের আশ -পাশ থেকে শাবল, কুড়াল এনে ভাঙ্গা শুরু হয় ইট, চুন ও সুরকির তৈরি বৃটিশ আমলের ব্রিজটি। কয়েক ঘন্টা চেষ্টার পর যান বাহন চলার অযোগ্য করে ফেলা হয় ব্রিজটিকে। সড়কে পাশে গজানো পুরনো বড় বড় সেগুন ও বট গাছ কেটে  সড়কে ফেলে রেখে ব্যারিকেড গড়ে তোলা হয়।
এপ্রিল মাসে আমাদের গ্রাম সাকছিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ট্রেনিং ক্যাম্প করা হয়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন তখনকার নেতা ন্যাপ  ভাসানী দলের অন্যতম নেতা কাজী জাফর আহমেদ। তার সহযোগী ছিলেন তার  রাজনৈতিক সহযোগী ও চাচাতো ভাই কাজী আফতাবুল ইসলাম গেদু ভাই। এ গ্রামে ট্রেনিং ক্যাম্পটি করার পেছনে ছিলেন কাজী জাফর আহমেদের প্রিয়ভাজন ওই গ্রামের সিরাজুল ইসলাম। এর আগেও কমরেড তোয়াহা, রাশেদ খান মেননসহ অন্যান্য বাম নেতারা তার বাড়িতে বেশ কয়েকবার মিটিং করেছিলেন। মাথায় হুলিয়া নিয়ে কাজী জাফর আহমেদ ছদ্মবেশে  ওই মিটিং এ যোগ দিতেন। সাকছি গ্রামের বড় বাড়ি বাঁশ ঝাড়ে ঘেরা পুকুর পাড়ে পাশের লাঠি ও একটি মাত্র এক নালা বন্দুক দিয়ে ট্রেনিং শুরু হয়। নূর হোসেন নামের ওই গ্রামের আনসারের একজন সাবেক প্লাটুন কমান্ডারের নেতৃত্বে ট্রেনিং শুরু হয়। আমিসহ ৪০-৫০ জন তরুণ ও যুবক ওই প্রশিক্ষণ অংশ নেই। পরে ক্যাম্পটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাতিসা নামক স্থানে স্থানান্তরিত হয়। আমাদের বাড়িতে আমার আম্মাসহ আমি শুধু থাকতাম। আম্মা চোখে দেখতেন না এবং অসুস্থ ছিলেন। তাকে দেখভাল আমিই করতাম। তাই তাঁকে একা ফেলে রেখে আমি ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিতে পারিনি। যা আজও আমাকে বেদনা দেয এবং আমৃত্যু আমাকে বেদনা দেবে।
যুদ্ধকালীন জুন মাসের ২ তারিখ। সকালে পাক বাহিনী আমাদের এলাকার তিন দিকঘেরাও করে ফেলে। আগুন লাগিয়েছে পাক বাহিনী। তাদের সহায়তা করেছে বাড়ির পাশের আমাদের পুরনো শত্রু আব্দুর রহিম। পাক বাহিনী আসার পরেই তাদের সাথে সে যোগ দেয়। তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধ চলে গিয়েছি। বাড়ির অন্যান্য পরিবারগুলো শহরে থাকার কারণে বাড়িটি খালি ছিল। সঙ্গত কারণেই সেনারা ধরে নিয়েছিল যে, সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছি।
বিকেলে পাক সেনারা এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে আসি। দেখি বাড়ি শ্মশানের মত হয়ে গেছে। পাক সেনারা গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে ঘর গুলো।
আম্মাকে খুঁজে পেলাম বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ে একটি তুলা গাছের নিচে বসা অবস্থায়। পাক বাহিনীর  সহায়তাকারী একজন বিহারী রিক্সা চালক আম্মাকে আগ থেকে চেনার  কারণে দয়া করে  সরিয়ে নিয়ে  ওখানে বসিয়ে রেখেছিল। আগুনে আমাদের সহায় সম্বল পুড়ে গিয়েছিল।পরনের কাপড় ছাড়া আমাদের আর কিছুই ছিল না। রান্না ঘরের একটি আধা জ্বলন্ত খুঁটিতে ছিদ্র করে রাখা অংশে জমানো সাড়ে চৌদ্দ আনা পয়সা খুঁটি কেটে বের করি। নগদ অর্থ বলতে ওটাই ছিল সম্বল।
পাশের বাড়িতে রাত কাটাই। একজন আত্মীয় কিছু কাপড়-চোপড় এনে দেন আমাদেরকে।খাবারও এনে খাওয়ান। কয়েক দিন পর আমরা কুমিল্লা শহরে মেজ ভাইয়ের বাসায় এসে উঠি। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে আমি লাকসাম রেল জংশনে বড় বোনের বাসায় যাই। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ লাকসাম জংশনে  বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে আমার বোন পরিবারের অন্যান্যদের সাথে নোয়াখালীতে গ্রামের বাড়ি চলে যান। আমি এবং আমার সেজো ভাই দুজনে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে হেঁটে রওনা হই। পথে দেখি মিত্র বাহিনী সীমান্ত দিয়ে লাকসামে ঢুকে গেছে। এরা পশ্চিম দিকে এগুচ্ছে।  সারাদিন হেঁটে সন্ধ্যায় এসে পৌঁছে বিজয়পুর এলাকায়। রাতে ঠাঁই হয় ঐ গ্রামের এক বাড়িতে। যুদ্ধকালীন সময়েও তাদের আথিতেয়তা আজোও ভুলিনি।  ওই সময়ে কোন যুবককে বাড়িতে জায়গা দেয়া ছিল ভয়ের।  পাক সেনা বা তাদের দোসররা মনে করতো মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ৮ ডিসেম্বর  সকালের নাস্তার পর দুই ভাই কুমিল্লার শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। বিজয়পুর স্কুল ভবনে তখন পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। তারা আমাদের কাছে শান্তি বাহিনীর দেয়া আইডি কার্ড দেখতে চায়। আমরা দেখাতে ব্যর্থ হই।  আমরা যুবক দুই ভাই স্বাস্থ্যবান ছিলাম।  আমাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা ভাবা যেতোই। কিন্তু তারা আমাদেরকে কেন জানি তা না ভেবে ছেড়ে দেয়। দুপুরেই আমরা শহরের বাসায় এসে পৌঁছি। দেখি শহরের মানুষ রাস্তায় আনন্দ উল্লাস করছে। মনে হলো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। রাতভর কুমিল্লা বিমানবন্দরে যুদ্ধ হয়। সকালে গিয়ে দেখি খাঁকি ইউনিফর্ম পরা পাক সেনারা মরে পড়ে আছে। তখন পর্যন্ত কুমিল্লা কুমিল্লা সেনানিবাসে সেনারা রয়ে গেছে। পরে তারা আত্মসমর্পণ করে। এর কদিন পর কুমিল্লা সেনা নিবাসে পাক বাহিনীর পতন হয়।
সেনা বাহিনীর হাতে আমাদের সম্পদ শেষ হলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দ সে দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক আমি এতো অনেক গর্বের।
লেখক: কুমিল্লা প্রতিনিধি-এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজ।