।।অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ।।
প্লাস্টিকের বোতলে পানি খাওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো :
১. ক্ষতিকর উপাদান ঃ গরমে যখন প্রকৃতির তাপমাত্রা বাড়ে তখন স্বাভাবিক প্লাস্টিকের বোতলে থাকা পানিও গরম হয়ে যায়। এতে প্লাস্টিকের নানা উপাদান বোতলে থাকা পানিতে মিশে যায়। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ক্ষতিকারক উপাদানগুলোও অনেক বেশি মিশতে থাকে। আর সেই পানি পান করলে তা শরীরের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়। তাই গরমে তৃষ্ণা নিবারণের আগে দেখে নিন সেটি প্লাস্টিকের বোতলে নেই তো।
২. গর্ভবতী নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঃ প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করলে গর্ভবতী নারীদের নানান সমস্যা এবং পেটের রোগ দেখা দিতে পারে। প্লাস্টিকের বোতলে বিপিএ নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। বিশেষত গর্ভবতী নারী এবং তাদের গর্ভজাত শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এটি।
৩. ডায়াবেটিস, মেদ ও আরও অনেক সমস্যা ঃ প্লাস্টিকে থাকে বাইফেনিল-এ নামক একটি উপাদান। এ উপাদান তাপ পেলে পানির সঙ্গে দ্রুত মিশে যায়। এটি শরীরে প্রবেশ করলে দেখা দিতে পারে ডায়াবেটিস, বন্ধ্যাত্ব, মেদ, মানসিক জটিলতার মতো সমস্যা। তাই এ ধরনের মারাত্মক সমস্যা থেকে দূরে থাকতে হলে প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করা বন্ধ করতে হবে ।
৪. ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় ঃ প্লাস্টিকের বোতলে থাকে থ্যালেট নামক একটি ক্ষতিকর উপাদান। প্লাস্টিকের বোতলে পানি রাখলে তা পানির সঙ্গে মিশে এ ক্ষতিকর উপাদান বাড়িয়ে দেয় লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি। সেইসঙ্গে এটি পুরুষের বন্ধ্যাত্বেরও কারণ হতে পারে। এছাড়া প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার স্তন ক্যানসারেরও ঝুঁকি বাড়ায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় বলে প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করার আছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। আপনি যদি প্লাস্টিকের বোতলে রাখা পানি খান, তবে সেই পানির সঙ্গে মিশে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে। ফলে কমতে থাকে প্রতিরোধ ক্ষমতা। সেখান থেকেই দেখা দেয় নানা অসুখের ভয়। এছাড়াও প্লাস্টিকের বোতল ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে না। দীর্ঘসময় প্লাস্টিকের বোতল বা জারে পানি রাখলে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া পানিতে জন্মানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এই পানি পান করলে আমরা ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া ঘটিত নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারি যা আমাদের জীবনও বিপন্ন করে দিতে পারে। তাই প্লাস্টিকের বোতলে পানি রেখে তা পান করা মোটেই উচিত নয়।
এছাড়াও প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারের পর তা ফেলে দিলে পরিবেশেরও প্রচুর ক্ষতি হয়, পরিবেশ দূষণ হয়। প্লাস্টিক অবিকৃত অবস্থায় মাটিতে থাকে দীর্ঘসময়। ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়, ফসল উৎপাদন কমে যায়। তাই আমাদের প্লাস্টিক বোতল ব্যবহারের চেয়ে হতে হবে সচেতন এবং এর বিকল্প কিছু ব্যবহার করতে হবে।
প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার আমাদের জীবন ব্যবস্থার অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। টুথব্রাশ, কটনবার, থালাবাসন এমনকি পানির ট্যাংকিও প্লাস্টিকের তৈরি। বিশ্বের প্রতি মিনিটে প্রায় পাঁচ লক্ষ প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয় বলে কথিত আছে। আমাদের জীবনযাত্রাকে এ প্লাস্টিক যেমন সহজ করেছে, অনুরূপ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমনই হুমকির মধ্যে ফেলেছে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও পৃথিবীর সকল প্রাণীকে। বর্তমানে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এক বড় অংশ দখল করেছে। গৃহস্থালির কাজে, স্কুল-কলেজে, অফিস আদালতে, বিয়ের অনুষ্ঠানে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে, ছোট বড় সব আচার-অনুষ্ঠানে খাবার-দাবার সরবরাহের ঝামেলা এড়ানোর জন্য সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। এসব প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের পর আমরা তা যেখানে সেখানে ফেলে রাখি। এ ব্যবহৃত প্লাস্টিক সাধারণত রিসাইকেল করা যায় না। এগুলো গিয়ে নদী-নালা, খাল-বিলে জমা হচ্ছে। এর জন্য আরো বেশি করে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। দেশে ২০২১ এ ১০ লাখ ৬০ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জা উৎপাদিত হয়েছে। যার মধ্যে ৯২,১০৪ টনই বিভিন্ন মিনিপ্যাক ও পণ্যসামগ্রীর কাভার বলে গবেষকরা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক এন্ড অ্যাটমোস্ফেরিক এডমিনিস্ট্রেশন তাদের এক গবেষণায় বলেছেন কফি, চা, কোমল পানীয় বা জুস সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত প্লাস্টিকের কাপ ৫০ বছর পর্যন্ত পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। দোকান থেকে কেনা পণ্য ও মুদিমাল বহন করার জন্য যে সব পলিব্যাগ ব্যবহার হয় সেগুলো প্রকৃতিতে মিশতে ২০ বছর সময় লাগে আর ডায়াপার এবং প্লাস্টিক বোতল প্রায় ৪৫০ বছর টিকে থাকে। ব্যবহার্য টিউব, শ্যাম্পো কন্ডিশনারের মিনি প্যাক, টি ব্যাগ, প্লাস্টিকে ওয়ান টাইম ইউজড চামচ, বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট, গ্লাস, প্লেট, কাপ স্ট্রসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক সামগ্রী বছরের পর বছর টিকে থাকতে পারে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশন না করে ফেলা হয় আশেপাশের ড্রেনে, রাস্তার পাশের গার্বেজে বা ভাগাড়ে বা জলাশয়ে। এর ফলে পানি, মাটি ও বায়ুর মতো পরিবেশের অন্যান্য গুরুত্ব¡পূর্ণ উপাদান সমূহে মারাত্মকরূপে দূষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর আশপাশ ও সীমানা প্রাচীর পরিষ্কার রাখা দুরূহ ব্যাপার। প্রাচীর ধার ঘেঁষে প্র¯্রাব করার প্রবণতা বন্ধ করা যায়নি, বন্ধ করা যায়নি সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলে যাওয়ার প্রবণতা। শহরের অনেক জায়গায় এবং রাস্তার অনেক অংশে স্থায়ী ভাগাড় তৈরি হয়ে আছে যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলানো হয়। দুর্গন্ধ ও গা ঘিন ঘিন করা পরিবেশে আশপাশের ব্যবসায়ীরা ও বসবাসকারীরা ওষ্ঠাগত। যার যার অবস্থান থেকে নিবেদিত কর্মী হিসেবে এ সকল পরিবেশ বিরোধী কর্মকান্ড থেকে সমাজকে উদ্ধার করতে হবে। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান, সরকার, গণমাধ্যমকর্মী, পলিসিমেকার, নেতাকর্মীরা গোটা ভ্রম্মান্ডের কল্যাণের কথা চিন্তা করে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। রিসাইকেল-রিসাইকেল-রিসাইকেল এর কোন বিকল্প নাই। প্রত্যেক নগরীতে, কয়েকটি শহর মিলে একটি এবং সুনির্দিষ্ট এলাকায় রিসাইকেল কর্মী, স্থান ও ফ্যাক্টরি নির্ধারণ করে দেশকে প্লাস্টিক বর্জ্য মুক্ত রাখতে পারি। এ কর্মযজ্ঞে নিবেদিত কর্মী হিসেবে প্রত্যেকের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে। প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে আইনী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্লাস্টিক পণ্যের উপর অধিক হারে শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে প্লাস্টিক বর্জ্যে চাপা পড়বে মানবসভ্যতা। এখনই সময়-মারাত্মক প্লাস্টিক দূষণ ঠেকানোর।
লেখক:সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com