মুরাদনগরে ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড়
মহিউদ্দিন মোল্লা ।।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাহেরচর পাচকিত্তা গ্রামের ফজর আলীর হাতে ধর্ষণের শিকার হন বলে মামলায় অভিযোগ করেন এক নারী(২৫)। ওই ঘটনার সময় সুমন নামের একজনের নেতৃত্বে নারীকে বিবস্ত্রের পর মারধর ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হয়। এটি এখন দেশজুড়ে আলোচিত ঘটনা। নির্যাতনকারী ফজর আলী মাদক, ডাকাতি,জুয়াসহসহ নানা অপরাধের সাথে যুক্ত রয়েছেন বলে দাবি করেন এলাকাবাসী। তার অপকর্ম নিয়ে একাধিকবার সালিশের ঘটনাও ঘটে। যৌন নির্যাতনের শিকার নারী, পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে রবিবার ভোরে পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত ফজর আলীসহ ৫জনকে গ্রেফতার করেছে। অভিযুক্ত ফজর আলী (৩৮) কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার বাহেরচর পাচকিত্তা গ্রামের পুর্বপাড়ার শহীদ মিয়ার ছেলে। এ ঘটনায় ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজন হলেন-বাহেরচর পাচকিত্তা গ্রামের অনিক, সুমন, রমজান ও বাবু।
ভুক্তভোগী নারী জানান, তিনি বিবাহিত। দুই সন্তানের জননী। ফজর আলী নামে এক ব্যক্তি থেকে তার মা ৫০ হাজার টাকা ধার নেন। টাকা নিয়ে তার সঙ্গে কথা হতো। এটি মেনে নিতে পারেননি ফজর আলীর ছোট ভাই শাহপরান। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। গত ২৬ জুন রাত সাড়ে ১১টার সময় ওই নারীর বাবার বাড়িতে যান ফজর আলী। গত ১৫দিন ধরে তিনি বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ফজর আলী যে সময় ভুক্তভোগীর বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন, ওই সময়ে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বাড়ির অন্য সবাই বাইরে অবস্থান করছিলেন। সে সুযোগে ঘরে প্রবেশ করেন ফজর আলী। ফজর আলী ঘরে প্রবেশের তিন মিনিটের মধ্যে চারজন যুবক এসে ওই নারী ও ফজর আলীকে বেদম মারধর করেন। এ সময় বিবস্ত্রের পর ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয়। স্থানীয়দের ধারণা ফজর আলীর পেছনে তরুণদের লাগিয়ে দেন তার ভাই শাহপরান। ২৭ জুন ফজর আলীকে আসামি করে ধর্ষণের মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। এদিকে বিবস্ত্র মারধরের ভিডিওচিত্র ২৮ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। ওই নারী জানিয়েছেন, যা হওয়ার হয়েছে। বিচার হলে তো আর আর ইজ্জত ফিওে আসবে না। তিনি এ ঘটনায় দায়ের করা ধর্ষণ মামলাটি আর পরিচালনা করতে চান না। ফজর আলীর বিচার চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,এমন মার মেরেছে তার অবস্থা তো ভালো না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুর রব বলেন, ফজর আলী আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে চলাফেরা করতো। এখন বিএনপির পরিচয় দেয়। তার কোন পদ পদবী নেই। সে এর আগেও একজন হিন্দু ও একজন মুসলিম নারীর সঙ্গে অপকর্মের চেষ্টা করে। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সালিশ হয়। ইয়াবা ব্যবসা, ডাকাতি ও জুয়া খেলে প্রচুর পয়সার মালিক হয়েছে। সে হলো সুবিধাবাদী। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
এদিকে নারীকে বিবস্ত্রের পর নির্যাতন ও ভিডিও করেছেন রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী সুমনের নেতৃত্বে কয়েকজন। এই তথ্য জানান স্থানীয় লোকজন, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা জানান।
রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকন বলেন, ধারণা করছি এটা পরকীয়ার ঘটনা। বৃহস্পতিবার ফজর আলী ওই বাড়ির দিকে রওনা করলে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সুমনের নেতৃত্বে কয়েকজন তাকে হাতেনাতে ধরার জন্য ফাঁদ পাতে। এ সময় ফজর আলী ওই নারীর ঘরে প্রবেশ করলে সুমনসহ তার সঙ্গীরা দরজা ভেঙ্গে তাদেরকে হাতেনাতে আটক করে। ফজর আলীকে বেধড়ক পিটিয়ে তার হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়। এসময় ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং ভিডিও ধারণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় জড়িত সুমনসহ সবাইকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। এ ঘটনায় জড়িত ফজর আলীর বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।
মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান বলেন, গ্রেফতার পাঁচজনের মধ্যে সুমন রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ও বাহেরচর গ্রামের আব্দুল হান্নানের ছেলে। আমরা তার রাজনৈতিক পরিচয় এবং স্থানীয়ভাবে তার কর্মকা- যাচাই-বাছাই করেছি। মূলত ছাত্রলীগ সভাপতি সুমনের নেতৃত্বে ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং ভিডিও ধারণ করা হয়। আমরা গ্রেফতারদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছি। ঘটনার নেপথ্যের কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা রয়েছি। স্থানীয়রা বলছেন, পরকীয়া কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আরও অনেক তদন্ত করা দরকার। তদন্তের পরই সব কিছু বেরিয়ে আসবে।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খাঁন জানান, ভুক্তভোগী নারীর মামলায় মূল অভিযুক্ত ফজর আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার দিন মারধরের পর তিনি আহত হয়েছেন। তাকে কুমিল্লা পুলিশ লাইন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এরপর জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া চারজনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে।
এদিকে এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি। কুমিল্লা নগরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ আত্মগোপনে চলে যায়। স্থানীয় ওসি ও একজন উপদেষ্টার বাবার পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আবার মাঠে সক্রিয় হয়েছে। আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতা না হলে ফজর আলী এমন বর্বর ঘটনা ঘটাতে পারতেন না। আমরা স্থানীয় ওসির প্রত্যাহার চাই। যুবলীগ নেতা আরিফ ওসি জাহিদুর রহমানের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে এটি বিএনপির কর্মকা- বলে প্রচার করে। আমাদের ধারণা, ওসি ও যুবলীগ নেতা আরিফ মিলে অপপ্রচার চালিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের খেপিয়ে দেশকে অস্থিতিশীলের চেষ্টা করছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া। উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মোল্লা মজিবুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম, মুরাদনগর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দুলাল দেবনাথ, সাধারণ সম্পাদক দয়ানন্দ ঠাকুর, উপজেলা মহিলা দলের আহ্বায়ক কাজী তাহমিনা আক্তার ও উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান উদ্দিন রায়হান প্রমুখ।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com