প্রিন্ট এর তারিখঃ জুন ১৫, ২০২৫, ১০:৫১ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুন ১৪, ২০২৫, ১০:৩৫ অপরাহ্ণ

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
ভিয়েতনামের বীর সন্তানদের নেতা হো চি মিন একদিন বলেছিলেন, "মানুষের মন পরাজয় জানে না। আমাদের পাহাড় থাকবে, নদী থাকবে, মানুষ থাকবে। আর আমরা আমাদের দেশ গড়ে তুলব—দশ গুণ সুন্দর করে।" এই বাক্য শুধু ভিয়েতনামের জন্য নয়, সমস্ত মুক্তিকামী জাতির জন্য এক আশাবাদের মন্ত্র। ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, মানুষ কখনো শেষ হয় না—আশা, স্বপ্ন আর সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ বারবার জেগে ওঠে।
ঠিক সেই রকম, আমেরিকার বর্ণ বৈষম্যের অন্ধকারে আলো হয়ে এসেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। তাঁর সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা "আই হ্যাভ আ ড্রিম" (আমার একটি স্বপ্ন আছে) কেবল এক শ্রেণির মানুষের অধিকার রক্ষার আওয়াজ নয়, ছিল এক নিপীড়িত জাতির পুনর্জাগরণের ডাক।
আমাদের বাংলাদেশও স্বপ্ন দেখে। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা জাতি আমরা। কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রায় ৫৪ বছর কেটে গেলেও এখনও গৃহীত হয়নি একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক রাষ্ট্র কাঠামো। আজও বাংলার কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান ফলায়, কিন্তু বাজারে পায় না ন্যায্য দাম। আজও শ্রমিক রক্ত ঝরিয়ে পোশাক বানায়, কিন্তু পায় না জীবনের নিরাপত্তা। আজও শহরে পড়ে থাকা পথশিশুটি জানে না আগামীকাল সে খাবে কিনা।
তবুও আমরা দেখি, জুলাই-আগস্টের সেই উত্তাল ছাত্র-জনতার জাগরণ। দেখতে পাই, দেশপ্রেমিক তরুণদের চোখে আগুন। তাদের প্রশ্ন—এই রাষ্ট্র কি কেবল গুটিকয়েক ধনীর জন্য? বাকিরা কি কেবল ত্রাণ-নির্ভর, ভোট-নির্ভর, বেঁচে থাকার যুদ্ধরত শ্রেণি হবে?
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা জটিল। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা বাণিজ্যের পণ্যে পরিণত হয়েছে। একদিকে উন্নয়নের আলো ঝলমলে বিজ্ঞাপন, আরেকদিকে গ্রামের পথে কাদায় হেঁটে স্কুলে যাওয়া শিশু, হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণকারী রোগী, কিংবা এক প্লেট ভাতের জন্য হাহাকার করা পরিবার।
তবুও আমরা আশা রাখি।
কারণ, সংস্কার কোনো বইয়ের তত্ত্ব নয়—এটি বাস্তবতা। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে পরিবর্তনের ডাক। সমাজে যখন বৈষম্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়
, তখনই দরকার হয় মৌলিক সংস্কারের। প্রথমে এটি কঠিন পথ। প্রতিকূলতা আসে। উপহাস হয়। কিন্তু ইতিহাস বলে, সংস্কার থেমে থাকে না। যারা সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য লড়ে, তারা শেষ পর্যন্ত আলো খুঁজে পায়।
প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশ কি সেই সংস্কারের পথ বেছে নেবে? আমরা জানি, শুধু সরকার পরিবর্তন নয়—চাই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন। শুধু নতুন মুখ নয়—চাই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। জনগণের দায়িত্বশীল অংশগ্রহণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠুক এক বাস্তবধর্মী, জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র।
নাগরিক অধিকার, মানবিক ন্যায়বিচার, শিক্ষার সমতা, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর মর্যাদা এবং যুবসমাজের ক্ষমতায়ন—এসবকে যদি রাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ করা যায়, তাহলে সত্যিই আলো আসবে।
তরুণদের কাছে আমাদের আহ্বান—আপনারাই আগামীর রূপকার। প্রযুক্তির এই যুগে দাঁড়িয়ে আপনারা শুধু স্লোগান নয়, পরিকল্পনা দিন। আন্দোলন করেন—কিন্তু গঠনমূলক। জাগরণ ঘটান—কিন্তু মানবিকতার আলোয়। রাজনীতির নামে হানাহানি নয়, বরং রাজনীতিকে মানবসেবার পবিত্র কাজে রূপান্তর করুন।
আমাদের স্বপ্ন—একটি নতুন বাংলাদেশ। যেখানে একটি শিশু সেও জন্ম নেবে সম্মানের সঙ্গে। যেখানে বৃদ্ধ পাবে শেষ জীবনের নিরাপত্তা। যেখানে মানুষের মেধা, শ্রম আর ভালবাসা কখনও অপচয় হবে না।
ভিয়েতনামের মানুষ পেরেছে, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় পেরেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা পেরেছেন। তাহলে আমরা কেন পারব না?
বাংলাদেশ একদিন এমন রাষ্ট্র হবে—যেখানে "অন্যায় করবো না, অন্যায় সহ্য করবো না" হবে জাতির মূল দর্শন। যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে মানবতা, ন্যায় এবং সুশাসন। সেদিন খুব দূরে নয়, যদি আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সত্যিকারের দায়িত্ব পালন করি।
লেখা শেষ করি এ কথায়—আশা যেন হারিয়ে না যায়। রাত যতই দীর্ঘ হোক, ভোর হবেই। অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, জনগণের আওয়াজ একদিন বিজয়ী হবেই। আমাদের পাহাড় থাকবে, নদী থাকবে, মানুষ থাকবে—আর একদিন আমরা গড়ে তুলব আমাদের দেশ, দশ গুণ নয়—শত গুণ সুন্দর করে। পরিশেষে, আশা রাখি আলো পাবো।