বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী মেজর জলিলের অগ্নিগাথা


বিজয়ের দুই সপ্তাহ পর স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজনৈতিক বন্দী, স্বাধীনতার পর সত্যিকারের দেশপ্রেমের প্রতীক
মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস রক্তে লেখা এক মহাকাব্য। এ ইতিহাসের প্রতিটি পাতা জুড়ে আছে শহীদের আত্মদান, মুক্তিকামী মানুষের আহাজারি, এবং অসংখ্য অগ্নিযোদ্ধার নামহীন কাহিনি। কিন্তু সেই ইতিহাসের অগ্নিস্রোতে কিছু নাম বজ্রের মতো দীপ্ত—তাদের একজন মেজর মোহাম্মদ আব্দুল জলিল। তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার নন; তিনি ছিলেন বিজয়ের মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক বন্দী—প্রথম রাজবন্দী।
শৈশব ও প্রাথমিক জীবন
মোহাম্মদ আব্দুল জলিল ১৯৪২ সালে বরিশালের চাখার উপজেলার শিকারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী, সংগ্রামী এবং প্রতিবাদী স্বভাবের। ছাত্রজীবনে তিনি ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করেন এবং পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। সামরিক জীবনের কঠোর প্রশিক্ষণ তাঁর মনোবল, শৃঙ্খলা ও নেতৃত্বগুণকে আরও প্রখর করে তোলে।
তবে তাঁর অন্তরে ছিল ভিন্ন এক স্রোত—দেশপ্রেম ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায়, বৈষম্য ও উপনিবেশিক মানসিকতা তাঁর হৃদয়ে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ আগুনই তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে।
আগুনের শপথ: মুক্তিযুদ্ধ ও ৯ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্ব
১৯৭১ সালের মার্চ—পূর্ব বাংলার আকাশ তখন ধোঁয়া আর রক্তে ঢেকে আছে। পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে, শহরে চালাচ্ছে হত্যাযজ্ঞ। সেই সময় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খল ভেঙে মেজর জলিল যোগ দেন মুক্তিকামী মানুষের কাতারে।
৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হয়ে তিনি দক্ষিণাঞ্চলের নদীমাতৃক অঞ্চলকে পরিণত করেন মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্গে। পদ্মা, মেঘনা, কীর্তনখোলা, আড়িয়াল খাঁ, শিরোমণি খাল—সব নদীপথে গেরিলা যোদ্ধাদের ঝাঁক বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত শত্রুর ওপর।
৭ এপ্রিল খুলনা রেডিও কেন্দ্র দখলের অভিযান তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে স্বাধীনতার আলো জ্বেলে দেয়। প্রায় ৮০ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি দক্ষিণাঞ্চলকে গড়ে তোলেন মুক্তির দুর্গে।
যুদ্ধ শেষে তাঁর অবদানই প্রমাণ করে—স্বাধীনতার জন্য কেবল অস্ত্র নয়, কৌশল, সাহস ও আত্মত্যাগের অদম্য মিশ্রণ প্রয়োজন।
বিজয়ের পর পরাধীনতা: প্রথম প্রতিবাদ ও প্রথম রাজবন্দী
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১—ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে, বিজয়ের পতাকা উড়ে যায় বাংলার আকাশে। কিন্তু বিজয়ের উত্তাল ঢেউ থামার আগেই স্বাধীনতার চেতনাকে আঘাত করছিল নতুন শৃঙ্খল।
ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কিছু অংশ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, ট্রাক, জাহাজ, এমনকি শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি পর্যন্ত লুট করতে শুরু করে। রাষ্ট্রক্ষমতাসীনরা নীরব থেকেছিল। কিন্তু মেজর জলিল মুখ খুললেন।
তিনি সাহসের সঙ্গে ঘোষণা দিলেন—“বাংলাদেশের সম্পদ লুট হতে দেব না। প্রয়োজনে গুলি চালাব।”
এই প্রতিবাদই তাঁর নিয়তি বদলে দেয়। ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী সহ্য করতে পারেনি এক স্বাধীনচেতা বাঙালিকে, যে মিত্রতার মুখোশের আড়ালে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তৎকালীন সরকারও শঙ্কিত হয়ে পড়ে; কারণ মেজর জলিলের কণ্ঠস্বর ক্ষমতার জন্য হয়ে উঠেছিল অস্বস্তিকর সত্য।
৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাত—বিজয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই যশোর সেনা ছাউনির অন্ধকার কারাগারে বন্দি করা হয় সেই মহান মুক্তিযোদ্ধাকে। তিনি লিখেছিলেন—
“আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমি হলাম প্রথম রাজবন্দী… অন্ধকার কক্ষে মানুষের রক্তের দাগ, ধর্ষিতার ছেঁড়া চুল—এ কি সেই স্বাধীনতা যার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি?”
প্রথম রাজবন্দীর ইতিহাস
মেজর জলিলকে প্রথম রাজবন্দী বলা হয় কারণ—
- তিনি স্বাধীনতার পর প্রথম রাজনৈতিক কারণে আটক হন।
- অন্যায় ও ভারতের লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই তাঁর অপরাধ ছিল।
- তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা স্বাধীনতা-পরবর্তী ক্ষমতা একচেটিয়া করতে তাঁকে বন্দি করে।
এটি নিছক আইনি নয়; ছিল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এবং নতুন শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
কারাগার থেকে রাজনীতির ময়দানে: জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা
কারাগার মেজর জলিলকে স্তব্ধ করতে পারেনি। বরং জেল থেকে বের হয়ে তিনি গড়লেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা।
১৯৭২ সালে জাসদ গঠিত হলে তিনি ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। ১৯৭৩ সালে তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সামরিক শাসন, একদলীয় কর্তৃত্ববাদ, বিদেশি প্রভাব—সব কিছুর বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন।
বারবার গ্রেফতার, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, অমানবিক নির্যাতন—কিছুই তাঁর মনোবল ভাঙতে পারেনি। তাঁর অগ্নিমন্ত্র—“অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা।”
এটি শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়; ছিল তাঁর জীবনদর্শন। তিনি বিশ্বাস করতেন—বিদেশি শক্তি বা অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্রের কাছে মাথা নত করলে স্বাধীনতার বিজয়ও পরাজয়ে রূপ নেবে।
লেখনী ও দর্শন: অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
মেজর জলিল ছিলেন শুধু যোদ্ধা নন; তিনি ছিলেন গভীর চিন্তাবিদ। তাঁর গ্রন্থসমূহ—
- ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’
- ‘সীমাহীন সময়’
- ‘সূর্যোদয়’
- ‘দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শন’
এসব গ্রন্থে তিনি স্পষ্ট করে লিখেছিলেন—“বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করবে এ দেশের জনগণ, বিদেশি প্রভুত্ব নয়। সত্যিকার মুক্তি আনতে হলে দরকার শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা।”
এ দর্শনই তাঁকে বিপ্লবী নেতা থেকে জনগণের মুক্তির অটল মশালবাহকে পরিণত করেছিল।
অন্তিম প্রহর ও অমরত্ব
১৯৮৯ সালের নভেম্বর—চিকিৎসার জন্য পাকিস্তানে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন মেজর জলিল। ২২ নভেম্বর তাঁর মরদেহ ঢাকায় আনা হয় এবং পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি খুব কম পেলেও জনগণের হৃদয়ে তিনি আজও অম্লান। তিনি প্রমাণ করেছেন—“মুক্তিযুদ্ধ কেবল বিজয়ের মুহূর্তে শেষ হয় না; স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে দরকার সাহসী প্রতিবাদ, ত্যাগ, এবং সত্য বলার শক্তি।”
ইতিহাসের অগ্নিপরীক্ষিত নায়ক
মেজর এম.এ. জলিল প্রমাণ করেছেন—স্বাধীনতার বিজয় মানে চূড়ান্ত মুক্তি নয়; বরং বিজয়ের পরও স্বাধীনতাকে রক্ষা করার লড়াই আরও কঠিন। তাঁর প্রতিবাদ, দর্শন ও সংগ্রাম শেখায়—স্বাধীনতা কোনো শব্দ নয়; এটি চর্চা, রক্ষা এবং সংগ্রামের অঙ্গীকার।
এ কারণেই মেজর জলিল কেবল ইতিহাসের এক অধ্যায় নন—তিনি স্বাধীনতার পর সত্যিকারের দেশপ্রেমের প্রতীক, বাংলাদেশের অগ্নিপরীক্ষিত নায়ক।
তথ্যসূত্র
- বাংলা উইকিপিডিয়া: মোহাম্মদ আব্দুল জলিল
- ইংরেজি উইকিপিডিয়া: Mohammad Abdul Jalil
- বাংলা পিডিয়া (Banglapedia): Jalil, Major Mohammad Abdul
- নিউ এজ বাংলাদেশ: Liberation War of Bangladesh: Actions, Reactions and Inactions of Foreign Powers