প্রিন্ট এর তারিখঃ জুলাই ১২, ২০২৫, ১১:৩৪ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুলাই ১২, ২০২৫, ২:৩৮ অপরাহ্ণ

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশ—একটি স্বাধীন দেশ, একটি মানচিত্র, একটি ইতিহাস, একটি জাতির স্বপ্ন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই বাংলাদেশ আসলে কার? জনগণের?
নাকি রাজনৈতিক দল এবং তাদের বিশাল কর্মীবাহিনীর? রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত বাস্তবতা যখন রাজনৈতিক আনুগত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, তখন এই প্রশ্নটি শুধু আবেগ নয়, বরং গভীর এক জাতীয় আত্মপরিচয়ের সংকট হয়ে ওঠে।
রাষ্ট্র, কিন্তু জনগণের নয়!
সংবিধানে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।” বাস্তবে কি তাই? ইতিহাস এবং বাস্তবতা বলে, ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় রাষ্ট্রের চরিত্র, প্রশাসনের আচরণ, এমনকি আইনের প্রয়োগ। রাষ্ট্র যেন এক দলীয় দাসে পরিণত হয়—যে দল ক্ষমতায়, তার পক্ষে সক্রিয়; আর বিরোধীদের প্রতি রূঢ় ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। এই দ্বৈত নীতি এবং পক্ষপাতমূলক আচরণই প্রমাণ করে, রাষ্ট্রটি একরকম ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীস্বত্বাধিকারিত্বে চলে গেছে।
ক্ষমতার পালাবদলে রাষ্ট্রের মালিকানা বদলায়
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের আত্মত্যাগ ছিল একটি জনগণের রাষ্ট্র গঠনের জন্য। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে রাষ্ট্রক্ষমতার ভার পড়ে গোষ্ঠী স্বার্থনির্ভর কিছু চক্রের হাতে। এরপর গণতন্ত্র ফিরে এলেও তা বহুক্ষেত্রে যেন শুধু ব্যানার, স্লোগান আর নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
ভোটারবিহীন নির্বাচন, বিরোধী দলের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভাব, দলীয়করণে নিমজ্জিত প্রশাসন—এসব মিলিয়ে রাষ্ট্রের মালিকানা সাধারণ নাগরিকের নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের হাতে বন্দি হয়ে পড়ে।
জনগণ: ব্যবহৃত আর বিস্মৃত
জনগণ যেন কেবল নির্বাচনের মৌসুমি সম্পদ। ভোট নেয়া পর্যন্ত তাদের গুরুত্ব, তারপর তারা হয়ে যায় দর্শক, নিঃশব্দ সহনশীলতা কিংবা নিরুত্তাপ প্রত্যক্ষদর্শী। গণতন্ত্রে যেখানে জনগণের মত ও অংশগ্রহণই মূল শক্তি হওয়ার কথা, সেখানে বাস্তবে জনগণ হয়ে ওঠে ক্ষমতার খেলার পটভূমি মাত্র। রাজনীতির মালিক জনগণ নয়, বরং রাজনীতির ভোক্তাবস্তু যেন তারা!
রাষ্ট্রীয় সম্পদের দলীয় ব্যবহার
সড়ক, সেতু, হাসপাতাল, স্কুল—সবই জনগণের টাকায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এসব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলকে জায়গা পায় দলীয় নেতার নামে। সরকারি গাড়ি, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও অনেক সময় নিরপেক্ষতার বদলে দলীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেন হয়ে উঠেছে দলীয় উৎসবের অলঙ্কার।
রাষ্ট্রব্যবস্থা কি ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়ে গেছে?
রাজনৈতিক নিয়োগ, চাকরি, পদোন্নতি, সরকারি সুযোগ—সবকিছুতেই দলীয় পরিচয়ই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি জাতি তার মৌলিক অধিকার তখনই হারায়, যখন নাগরিকত্বের চেয়ে বড় পরিচয় হয়ে যায় দলীয় অনুগত্য। এই পরিস্থিতি নাগরিকদের আত্মমর্যাদাবোধ, স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রে সমান অংশগ্রহণের অধিকারকে চরমভাবে আঘাত করে।
প্রত্যাশার বাংলাদেশ কোথায়?
যে স্বপ্ন নিয়ে এই দেশের জন্ম, তা ছিল একটি সমান অধিকারভিত্তিক, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণের। যেখানে একজন কৃষক, শিক্ষক, শ্রমিক, দিনমজুর এবং তরুণ ছাত্র—সবাই বলবে, “এই দেশ আমার!” কিন্তু বাস্তবে তারা বলতেই পারে না। বরং প্রশ্ন আসে: “বাংলাদেশ তুমি কার?”
একটি অনিবার্য জিজ্ঞাসা
“বাংলাদেশ, তুমি আসলে কার?”—এটি কেবল একটি কাব্যিক বেদনা নয়; এটি জাতির আত্মিক আর্থ-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন জনগণের হাতে না থেকে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর কব্জায় চলে যায়, তখন রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র থাকে না, সেটি হয়ে ওঠে একপ্রকার ‘রাজনৈতিক সম্পত্তি’।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ—সুশাসন, জবাবদিহি, এবং গণতান্ত্রিক চেতনার পুনর্জাগরণ। নাগরিক অধিকার ও সম্মান যখন রাজনৈতিক পরিচয় নিরপেক্ষভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখনই রাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে জনগণের হবে।
আমরা সেই দিনের আশায় থাকি—যে দিন বাংলাদেশ আবারও হবে জনগণের; যেখানে দল নয়, গোষ্ঠী নয়, ক্ষমতা নয়—রাষ্ট্র হবে মানুষের, নাগরিকের, শ্রমিকের, ছাত্রের, প্রবীণের, প্রান্তিকের। সেদিনটা যেন খুব বেশি দূরে না হয়।